ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ০১:৩১, ৫ আগস্ট ২০২২

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যুগশ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালীএটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্যমা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি দাঁড়িতে ঢাকবার জোটি নেই’- আমরা বাঙালী এবং আমরা যে যে ধর্মেরই হই না কেন আমাদের মূল পরিচয় বাঙালী এবং এই জায়গায় আমরা সকলেই এক এমন সত্য দৃঢ় উচ্চারণ যার কণ্ঠে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে যোগদান করে সভাপতির বক্তব্যে ভারতীয় উপমহাদেশের এক অনন্য জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল

এই উপমহাদেশে যেখানে মাঝে মধ্যেই জ্বলেছে বিভেদের আগুন, সেখানে হিন্দু বা মুসলিম এই পরিচয়ের চেয়ে আমরা যে বাঙালী এবং একই সুতায় গাঁথা সেই মহাসত্যই তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনআমরা সবাই প্রথমে বাঙালী এবং এখানে কোন ভিন্নতা নেই, কোন মতভেদ নেই বা থাকার কথাও নাপাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর থেকেই যখন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় তখন তিনি বাংলার পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেনতার এই অবস্থান বাঙালীর ভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে বলিষ্ঠ করে তুলেছিলতিনি প্রকৃত অর্থে একজন প-িত ছিলেন যার পা-িত্যের দুত্যিতে আলোকিত হয়েছে গোটা উপমহাদেশ

তার এই পাণ্ডিত্যের জন্য তাকে বলা হতো চলন্ত এনসাইক্লোপডিয়াজ্ঞান অর্জন একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া এবং একজন প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তি তার জীবনকালের পুরোটা সময় জ্ঞান চর্চা করেন ও জ্ঞান বিতরণে নিরলস পরিশ্রম করে যানপৃথিবীতে প্রকৃত জ্ঞানী বা জ্ঞানচর্চাকারী ব্যক্তির সংখ্যা খুব বেশি নয়এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহযিনি সত্যিকার অর্থে একজন জ্ঞানের বাতিঘর

জ্ঞানসাধনা ছিল যার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যশিক্ষা এবং শিক্ষকতা ছিল তার আজীবনের ব্রততিনি ছিলেন একজন শিক্ষক যিনি বহু ভাষা সম্পর্কে শিক্ষা নিয়েছেন এবং একজন দার্শনিকলিখেছেন প্রচুর বইশিক্ষক হিসেবে একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেনবিবিসি বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জরিপে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তালিকার ১৬তম স্থানে আসেন

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেনতার পিতার নাম মুনশী মফিজ উদ্দিন আহমেদতিনি হাড়োয়া গ্রামের গোরাচাঁদের প্রাচীন দরগাহর একজন খাদেম ছিলেনতার মাতার নাম হুরুন্নেসাশহীদুল্লাহ নামটি তার মা পছন্দ করে রেখেছিলেনতার পড়ালেখার শুরু হয় তার গ্রামেইগ্রামের পাঠশালাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিলছোটোবেলা থেকেই তার বিভিন্ন ভাষার প্রতি আগ্রহ ছিলতার বই পড়ার প্রতিও আকর্ষণ ছিলজানা যায়, তিনি স্কুল জীবনেই একাধিক ভাষা পড়তে শিখেছিলেন

ভাষা শেখার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল যা তাকে বহুভাষা শিখতে উসাহ দিয়েছিলতিনি ১৮টি ভাষায় প-িত ছিলেন (বাংলা, ফারসি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলি, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি) এবং জানতেন প্রায় ২৪টি  (কোন আলোচনায় ৩০টি বা ২৭টির উল্লেখ আছে) ভাষা

তার জীবনের শুরুই হয় শিক্ষকতা দিয়েতার জীবনে তিনি বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেনঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ে তিনি শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেনতিনিই প্রমাণ করেন যে বাংলা ভাষার উপত্তি হয়েছে গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকেবহু সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন

তিনি ১৯১১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠার সভাপতি ছিলেনমাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে তার জোরালো কণ্ঠ ছিলতিনি দৃঢ় কন্ঠে বাংলাকে মাতৃভাষা করার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনিতিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাইড অব পারফর্মেন্স লাভ করেন এবং ১৯৬৭ সালে ফরাসি সরকার তাকে নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্টস এন্ড লেটারস পদক প্রদান করেন

তিনি বলেন, যে দেশে গুণের সমাদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে নাআমাদের কথাবার্তায়, ভয়-ভালবাসায়, চিন্তা ও কল্পনার ভাষা বাংলাতাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলাবাংলাকে এমন চমকারভাবে উপস্থান করতে পেরেছিলেন তিনি ভাষাকে ভালবাসতেন বলেইতিনি ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণ এবং বাঙালী চেতনা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেনলক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাঙালী চেতনা যা বাঙালীর অস্তিত্বের সঙ্গে, অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত

তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বই লিখেছেন যা যুগ যুগ ধরে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেতিনি প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুতোষগ্রন্থ রচনা করেছেনতার সংকলন ও সম্পাদনায়ও বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছেতার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- ভাষা ও সাহিত্য, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, দীওয়ানে হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নবী করিম মুহাম্মাদ, ইসলাম প্রসঙ্গ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খ-), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন, অমর কাব্য

তার শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হলো- শেষ নবীর সন্ধানে, ছোটদের রাসূলুল্লাহ এবং সেকালের রূপকথাএই জুলাই মাসেই তার জন্ম ও মৃত্যু হয়েছেএ উপমহাদেশ হারিয়েছে এক জ্ঞানতাপসকেতার মতো জ্ঞানীবান মানুষ পৃথিবীতে খুব কম জন্মগ্রহণ করেএই মহান মানুষের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইল

×