ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

একজন রত্নগর্ভা মাহমুদা নুরুন্নাহার

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ২ জুন ২০২৩

একজন রত্নগর্ভা মাহমুদা নুরুন্নাহার

আজাদ প্রোডাকসের দেওয়া সম্মাননা নিচ্ছেন রতœগর্ভা মা

মা শব্দটাই মাধুর্যমাখা এক অপরিমেয় স্নেহাতিশয্যের  পরম নিবেদন। মায়ের অন্তর্নিহিত বোধেই প্রচ্ছন্ন থাকে মায়া-মমতায় ভরা অনির্বাণ স্নিগ্ধতা। আর সফলতা তো সম্পৃক্তই থাকে মাতৃত্বের অপার মহিমায়। সব দেশে সব কালের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা গর্বিত মায়ের অনন্য উপহার। তেমন এক সফল ও যোগ্যতম মা মাহমুদা নুরুন নাহার। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া মাহমুদার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তা। তার ১১ সন্তানের মধ্যে মাহমুদা ছিলেন সপ্তম। বাবার ছিল বদলির চাকরি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বসতি স্থাপন করা এই পুলিশ কর্মকর্তার জীবন ছিল পরিবর্তিত গতি প্রবাহে আবর্তিত।

সেই সুবাদে কন্যা মাহমুদার শিক্ষা জীবন শুরুর গল্পটাও অন্য রকম। দিনাজপুরের সারেদশ্বরী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ নিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী জীবন পার করেন। পরবর্তীতে ঠাকুরগাঁও জেলায় পিতার নতুন কর্মস্থল হলে সেখানেই লেখাপড়ার পাঠ শুরু করাও নিত্য জীবনের অবধারিত যোগ। ঠাকুরগাঁ বালিকা বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯৬১ সালে এখান থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পিতৃগৃহে শিক্ষা কার্যক্রম অবারিত করা তৎকালীন সময়ের এক কঠিন প্রাচীর। ১৯৬৩ সালেই ঠাকুরগাঁও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে শিক্ষার আলোয় দুতিময় করে তোলেন। মেধাবি, চটপটে, দুরন্ত এই শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের কবল থেকে উত্তীর্ণ হন নিজের অভাবনীয়  প্রচেষ্টা আর দুরন্ত মনোবলে।

তবে পরিবারিক অনুকূল ও সুস্থ পরিবেশকেও  সর্বাধিক আমলে নেয়াও সঙ্গত। চিরায়ত সাংস্কৃতিক বোধে নিবেদিত মাহমুদা ১৯৬৫ সালে ঠাকুরগাঁ কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করা এক অনন্য জীবন পরিক্রমা। পর পরই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। তবে যথার্থ সময়ে। স্বামী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুস সোবহান শুধু সুশিক্ষিতই নন শিক্ষানুরাগীও বটে। স্বাধীনচেতা ও অধিকার সচেতন স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনি স্নাতকোত্তর পর্বে ভর্তির সুয়োগ পেলেও লেখাপড়া আর এগিয়ে নিতে পারেননি। সন্তান আগমনের পরম আকক্সক্ষায় অন্য সবকিছু যেন ভুলেই  গেলেন। তৎকালীন শিক্ষিত এই নারী ভাবতে বসলেন নতুন প্রজন্মের পৃথিবীতে আসা অত সহজ ব্যাপার নয়। সেখানে সচেতন মায়ের দায়বদ্ধতাও যতœ আত্তির প্রয়োজন। সেখানেই শেষ নয়।

বরং মাতৃত্বের নবতর আকাক্সক্ষায় সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানো যেন সার্বক্ষণিক চেতনায় ঘিরে থাকে। মাতৃত্বের অনন্য আসনে অভিষিক্ত হতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। সময় গড়িয়ে যায়। পেশার জন্য হরেক সুযোগের হাতছানিকেও এক সময় নির্লিপ্তভাবে নাকচও করে দেন। কারণ তখন থেকে তিনি শুধুই মা- অন্য কিছু ভাবার অবকাশ আর থাকেইনি। ক্রমে এই নিবেদিত মা চার সন্তানের মাতৃত্বের জায়গায় নিজেকে পূর্ণ করতে যেন সদা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, নৈতিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক চর্চা সবই যেন সন্তানদের জন্য উৎসর্গও করে দিলেন। কোন এক সময় যোগ্যতম মায়ের আসনটিও হাতের মুঠোয় চলে আসে। প্রথম সন্তান মো. খালেকুজ্জামান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, দ্বিতীয় সন্তান সাবেরা সোবহান-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা মেধাবি শিক্ষার্থী।

বর্তমানে ঢাকার উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। তৃতীয় সন্তান তাহমিনা সোবহান ১৮তম বিসিএস ক্যাডার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা যোগ্যতম শিক্ষার্থী। বর্তমানে টঙ্গী সরকারি মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। চতুর্থ সন্তান লে. কর্নেল মো. তৌহিদুজ্জামান, বিএসপি, পিএসপি। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ২৪ পদাতিক ডিভিশনে কর্মরত-আছেন। 
পারিবারিক সুস্থ আবহে সন্তানের সাফল্য বিবেচনায় একজন মা নিজের কর্মক্ষেত্রকেও তোয়াক্কা করেননি যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে। মনে পড়ে যায় নেপোলিয়নের সেই বিখ্যাত সারগর্ভ উক্তি- আমাকে একজন যোগ্য মা দিলে আমি একটি শ্রেষ্ঠ জাতি উপহার দিতে সক্ষম। আমাদের অজানা নেই দেশের শ্রেষ্ঠ এবং যোগ্যতম সন্তানরা কোনো না কোনো সফল মায়ের গর্ভজাত। তেমন সব রত্নগর্ভা মা জাতির অহঙ্কার ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সফল অংশীদারও বটে। বাংলাদেশে ‘আজাদ প্রোডাকস’ এই সব গর্বিত মাকে সম্মাননা দিয়ে তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ত্যাগ, তিতিক্ষায় দক্ষ সন্তানের সফল কারিগর এই মাহমুদা নুরুন নাহার রত্নগর্ভা মায়ের আসনটি অলঙ্কৃত করেন ‘আজাদ প্রোডাকটসের অনবদ্য বিবেচনায়। মা দুনিয়ায় সব চেয়ে মহত্ত্বম স্বর্গীয় সুধা।

যারা এমন স্নেহাতিশর্য থেকে বঞ্চিত তাদের মতো হতভাগ্য কেউ নয়। মায়ের সবচেয়ে মহত্ত্বম বোধটি হচ্ছে- প্রত্যাশা কিংবা প্রাপ্তির কোনো ছিটে ফোঁটা ইচ্ছের অনুপস্থিতি। বরং নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে পারাটাই পরম আকাক্সিক্ষত প্রত্যয়। মা দশমাস দশদিন যে সন্তানকে গর্ভধারণ করে জঠরে লালন ধারণ করেন তার দাম নাকি একেবারে অপরিশোধ্য। সম্ভবত তেমন তাৎপর্যে মা কিংবা মাতৃত্ব দিবসকে কোনো একটা দিনে আটকেও রাখা যায় না। মা প্রতিদিনের অনুক্ষণের। যার স্নেহ কিংবা মমতাঘন সাহচর্য ব্যতিরেকে কোনো সন্তানের জীবন চলার পথ সুস্থির কিংবা নির্বিঘœ থাকেই না। সন্তান ছাড়া কোনো মায়ের প্রতিদিনের জীবনও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে পরিপূর্ণ হয় না।

অনবদ্য এবং অবিচ্ছেদ্য এই সম্পর্কের টান শুধু নাড়ির নয় বরং নিত্য জীবন ঘনিষ্ঠ স্নেহ-মায়া-মমতায় যে বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয় সেখানেই। মাহমুদা নুরুন নাহার অনেক সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মযোগেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। জরুরি এবং কল্যাণকর বিভিন্ন কর্মসূচি। তার সরব উপস্থিতি অনেক মেয়েকে সামাজিক অভিশাপ থেকে মুক্ত করাও এক প্রকার মাঙ্গলিক প্রতিবিধান। বাল্যবিয়ে রোধ করা, নারী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা ছাড়াও স্বাবলম্বী হতে সংশ্লিষ্টদের পাশে দাঁড়ানো যতখানি সম্ভব করে যেতে অকুষ্ঠচিত্তে এগিয়েও আসেন। অন্যায় অবিচার, বিপদ-আপদেও ভুক্তভোগীদের পাশে থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

×