
রাবেয়া খাতুন রাবু
রাবেয়া খাতুন রাবু। বাংলাদেশের সাংস্কৃতি অঙ্গনে প্রতিশ্রুতিশীল এক মেধাবী নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এই শিক্ষার্থী দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। সাংস্কৃতিক শূন্যতায় থিয়েটারের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের অংশীদারিত্ব ও দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন সম্ভাবনাময় এই তরুণী।
একজন থিয়েটার কর্মী হিসেবে নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন রাবেয়া রাবু। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সারথী হিসেবে মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে চান। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার হিসেবে অবদান রাখতে চান দেশ গঠনে। স্কুলজীবন থেকেই প্রতিশ্রুতিশীল রাবেয়া রাবু জড়িয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।
দেশের সেরা বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরও বিকশিত হতে থাকে। গত ৫ ও ৬ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটম-ল মিলনায়তনে তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘ডাকঘর’। আর্ট হাউজের থিয়েটার উইং ‘ক্লাসোড্রাম’তে ছয় মাসব্যাপী অভিনয় কর্মশালা শেষে দ্বিতীয় আবর্তনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়েছে নাটকটি।
ডাকঘর নাটকটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সাঙ্কেতিক নাটক। এখানে যা অপ্রকাশ্য তা শেষমেশ অপ্রকাশিতই থেকে যায়। এর প্রধান চরিত্র অমল। অমলের মা ছোটতেই মারা যায়। বাবাও চলে যান কিছুদিন পরই। এরপর নিঃসন্তান দম্পতি মাধব দত্ত তাকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু এক অজানা রোগে অমল আক্রান্ত হলে কবিরাজ তাকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেন।
কিন্তু কিশোর মনের দূরন্ত সত্তা ঘরে বসে থাকার বিরুদ্ধে। তবুও তাকে ঘরেই থাকতে হবে। শেষটায় বহু অনুনয় করে পিসি মশাই মাধব দত্তের কাছে রাস্তার ধারের ঘরে বসে থাকার অনুমতি মেলে। সেখানে সে সারাদিন বসে কখনও দই ওয়ালা, কখনও প্রহরী, কখনও গাঁয়ের মোড়ল, কখনও ফুল তুলতে যাওয়া মালিনীর মেয়ে সুধা, আবার কখনও দুরন্ত গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে কথা ফেরি করে।
প্রহরীর সঙ্গে সংলাপকালীন বড় বাড়ির নিশানা দেখতে পায়। জিজ্ঞেস করে সে ঘরে কেন নিশানা দেয়া। প্রহরী তখন তাকে ডাকঘর ও ডাক হরকরার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাদের কাজ সম্পর্কে অমলকে জানায়।
আর্ট হাউস ‘আত্মা, সত্তা ও চিত্তের বিকাশ’ স্লোগানকে সামনে রেখে ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করে। মূলত শিল্পের প্রায়োগিক বিচরণ যে উঠোনে মিলিত হয়েছে তার নাম আর্ট হাউস এবং আর্ট হাউস সেই নিমিত্তেই কাজ করে যাচ্ছে। তাদের অনেক বিভাগের মধ্যে অন্যতম হলো ক্লাসোড্রামা।
এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮১তম প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ক্লাসোড্রামা নিবেদন করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নাটক ‘ডাকঘর’। এতে অভিনয় করেছে ক্লাসোড্রামা’র দ্বিতীয় আবর্তনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা। ‘ডাকঘর’ প্রসঙ্গে নির্দেশক রাবেয়া রাবু জানান, শিল্পের সঙ্গে ব্যাকরণের আচরণ রূপ আর অরূপের মতই, প্রায় ছায়াসঙ্গী। রূপের মানুষ যেমন ঐশ্বরিক অরূপে নিজেকে সন্ধান করে, শান্তির শীতলতা খোঁজে।
ব্যাকরণও তেমনি শিল্পের মাঝে নিজের অস্তিত্ব খোঁজে, নিরীক্ষণ করে। কিন্তু সেই অরূপের পথে যাওয়ার পূর্বে মানুষকে রূপের হাজার স্রোতে ভাসতে হয়, ডুব সাঁতারে টিকে থাকতে হয়। অনুসন্ধান করতে হয় জীবনের শেষ গন্তব্যটা আসলে কোথায়, তা কতদূর বা তা কত কাছাকাছি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল চরিত্র সেই পরীক্ষণ প্রবাহ বা মানসরূপ। যাপনকালে কত মানব চরিত্রের সন্নিবেশ, কত মায়া, কিন্তু এরপর শেষ না হতেই চলে যাওয়া। কিন্তু এই চলে যাওয়া কি শুধু চলে যাওয়া নাকি অন্য নতুনের শুরু, ভিন্ন চরিত্রের অপেক্ষা? পারাপারের এই সময়ে সবই যেন আপেক্ষিক, সাংকেতিক।
ভিন্ন আঙ্গিকে মনে হয়, তৃষ্ণার্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন তাঁর সৃজন ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল চরিত্রের মাধ্যমে দিগি¦দিক চোখ ভরে দেখতে চেয়েছেন, পেশা বদলের রূপকে চরিত্র বদল করে ভিন্ন শরীরে, ভিন্ন সীমানায়, ভিন্ন স্বরূপ অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন।
আদতে এই অনুসন্ধান জীবনের অনুসন্ধান, জীবনকে নিরীক্ষণ করে দেখার আকুতি। যেন মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়েও মানুষ স্বপ্নকে পকেটে পুরে রাখার সাহস রাখে। সৃষ্টিকে, সত্তাকে সৃজন করবার মানস না ছাড়ে।
নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখা রাবেয়া রাবু বাগেরহাট সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর ঢাকা সিটি কলেজে সম্পন্ন করেন এইচএসসি। এরপর সুযোগ পান স্বপ্নের বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোমধ্যে নিজের প্রতিভা জানান দেয়া রাবেয়া রাবু অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ডিনস এ্যাওয়ার্ড।