
ছবিঃ সংগৃহীত
আমাদের শরীরে এমন কিছু অঙ্গ আছে যেগুলো প্রতিদিন নিরলসভাবে কাজ করে চলে – আমরা টেরও পাই না। লিভার তেমনই এক নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা। খাবার হজম, শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দেওয়া, শক্তি জমিয়ে রাখা – এসব সব কাজই করে এই ছোট্ট অঙ্গটি।
তবে, আপনি জানেন কি, এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিকেই আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি?
লিভার রোগ: যখন শরীর কথা না বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে
লিভারের সমস্যা খুব নীরবে শুরু হয়। প্রথমে আপনি হয়তো শুধু ক্লান্ত লাগা, খাবারে অরুচি বা হালকা বমি বমি ভাবের মতো সাধারণ উপসর্গ টের পাবেন। এগুলোর পেছনে লিভারের সমস্যা আছে – এটা আমরা অনেক সময় ভাবিই না।
তবে সময়ের সঙ্গে যখন লিভার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন চোখ আর ত্বকে হলদে ভাব দেখা দেয় – যাকে আমরা চিনি জন্ডিস নামে। সেটাই হয়তো প্রথম বড় সংকেত।
এখন ভাবছেন, "আমি তো নিয়মিত মদ খাই না!"
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ভাবছেন – লিভারের রোগ শুধু মদের জন্য হয় না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু সাধারণ অভ্যাসই অনেক সময় এই নীরব ক্ষতির পেছনে দায়ী।
১. মদ্যপান – যতটা কম, ততটাই ভালো
লিভার আমাদের শরীর থেকে অ্যালকোহল বের করতে চেষ্টা করে। কিন্তু আপনি যদি নিয়মিত বা অতিরিক্ত পান করেন, তাহলে লিভার ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
প্রথমে লিভারে চর্বি জমে (Fatty Liver), পরে প্রদাহ হয় (Hepatitis), আর একসময় সেটা রূপ নেয় ভয়ংকর সিরোসিসে – যেখানে লিভার স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাঁচার উপায়?
- সপ্তাহে ১৪ ইউনিটের বেশি অ্যালকোহল নয়
- সপ্তাহে অন্তত কয়েক দিন একেবারে অ্যালকোহলমুক্ত থাকুন
২. খাবারের গড়বড় যত গড়ায়, লিভারের ক্ষতি তত বাড়ে
আপনি যদি মনে করেন "আমি তো মদ খাই না, কাজেই চিন্তার কিছু নেই" – তাহলে একটু থামুন।
লিভারে চর্বি জমা শুধু মদে নয়, অস্বাস্থ্যকর খাবারেও হয়।
আজকাল এই সমস্যার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে: MASLD (আগে বলা হতো NAFLD)।
দেখা গেছে, বেশি চিনি, ভাজাভুজি, প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে লিভারে চর্বি জমে। এটি ধীরে ধীরে প্রদাহ আর ক্ষতের দিকে নিয়ে যায়।
সমাধান খুবই সহজ:
- বেশি করে খেতে হবে সবজি, ফল, বাদাম, ডাল, মাছ
- চিনিযুক্ত পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন – লিভারকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে
৩. ব্যথানাশক ওষুধও হতে পারে লিভারের শত্রু
সাধারণ মাথাব্যথা বা জ্বর হলে আমরা হুট করে প্যারাসিটামল খেয়ে ফেলি। কিন্তু নিয়ম না মেনে খেলেই বিপদ।
লিভার যখন এই ওষুধ ভাঙে, তখন একটা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়। শরীর সেটাকে মোকাবিলা করতে পারে – কিন্তু মাত্রা বেশি হলে সেটা সম্ভব হয় না। এমনকি অ্যালকোহলের সঙ্গে এই ওষুধ খেলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়।
মনে রাখবেন: নিয়মিত ব্যথানাশক দরকার হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
৪. শরীরচর্চার অভাব – নিঃশব্দে জমে লিভারে চর্বি
যারা দিনভর বসে থাকেন, হাঁটাহাঁটি বা শরীরচর্চা করেন না, তাদের লিভারে চর্বি জমার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কিন্তু দারুণ খবর হলো, এমনকি ওজন না কমলেও, নিয়মিত ব্যায়ামে লিভারের ফ্যাট কমে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে,
- মাত্র ৮ সপ্তাহের ব্যায়ামে লিভারের চর্বি ১৩% পর্যন্ত কমেছে
- সপ্তাহে ৫ দিন আধা ঘণ্টা হাঁটলেই উপকার পাওয়া যায়
৫. ধূমপান – শুধু ফুসফুস নয়, লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়
ধূমপানের ক্ষতি নিয়ে আমরা যতটা জানি, তার অনেকটাই লিভার সম্পর্কিত তথ্য অজানা থেকে যায়। তামাকের ধোঁয়ার বিষাক্ত উপাদান লিভারের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। ধীরে ধীরে তা কোষ নষ্ট করে, রক্তপ্রবাহ কমিয়ে দেয় এবং লিভারের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
সত্যি কথা বলতে, যুক্তরাজ্যে লিভার ক্যানসারের প্রায় ২০% কারণ ধূমপান।
সিগারেট ছাড়ুন, লিভার বাঁচান।
লিভার যত্ন চায়, অবহেলা নয়
লিভার অনেক সহনশীল – কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। সময় থাকতে সচেতন হোন।
- মদ সীমিত করুন
- ধূমপান ছাড়ুন
- সঠিকভাবে ওষুধ ব্যবহার করুন
- খাবারে ভেজাল বাদ দিন
- শরীরচর্চা করুন
- পানি পান করুন
আর যদি নিয়মিত ক্লান্তি, বমি বা চোখ-চামড়ায় হলুদ ভাব দেখা দেয় – চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করবেন না।
নিজের শরীরকে ভালোবাসুন, লিভারকে ভালো রাখুন। সুস্থ জীবন বেছে নিন।
মারিয়া