
২০০৮ সালের এপ্রিলের ৮ তারিখ দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সেদিন কুর্মিটোলা এয়ারবেস থেকে আকাশে উড্ডয়ন করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চিংডুং এফ সেভেন নামের একটি এয়ারগার্ড জেড বিমান। উড়ন্ত অবস্থায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমানটি। সেই ঘটনার পর থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছরে ১৪টি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বিমান। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মানুষের সংখ্যা ঠিক কত সেটি নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এমন দুর্ঘটনা বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কতটা দুর্বল বাংলাদেশের অবকাঠামো।
২০০৮ সালের সেই ঘটনার ঠিক দুই বছরের মাথায় ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে দুটি পিটি সিক্স প্রশিক্ষণ বিমান। এরপর ২০১২ সালের এপ্রিলে আরেকটি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে।
২০১৫ সালের মে মাসে এম আই সেভেনটিন হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা, একই বছরের জুনে এফ সেভেন এমপি যুদ্ধবিমান বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ইয়র্ক হান্ড্রেড থার্টি এবং একই বছরের ডিসেম্বরে একই সিরিজের আরও দুটি যুদ্ধবিমান মাঝ আকাশে সংঘর্ষে বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে।
এতসব দুর্ঘটনার পরও নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফলে ২০১৮ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত ঘটেছে আরও চারটি সামরিক বিমান দুর্ঘটনা। সবশেষ এ বছরের ২১ জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেছে। এদিন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে আচড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে।
এসব ঘটনার পেছনের কারণ জানতে একটি বেসরকারি গণমাধ্যম কথা বলেছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসিরের সাথে। প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যান্ত্রিক ত্রুটি, পাইলটের ত্রুটি ও খারাপ আবহাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনার তো বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। একটা হচ্ছে যান্ত্রিক ত্রুটি। আরেকটা হচ্ছে পাইলটের ত্রুটি। আরেকটা হচ্ছে খারাপ আবহাওয়া। যান্ত্রিক ত্রুটি হতে পারে যদি আমার মেকানিক্যাল পার্টসের স্বল্পতা থাকে বা সার্ভিসিং এর কোন ঘাটতি থাকে। আর পাইলটের ত্রুটি হতে পারে পাইলটের প্রশিক্ষণের মান বা তার ক্রাইসিস হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি এই সংক্রান্ত দুর্বলতা যদি থাকে। দুর্ঘগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে প্লেনটা যাওয়ারই কথা না, ওড়ারই কথা না।
তিনি আরও বলেন এই বিষয়গুলো পুরোপুরিভাবে বোঝা যাবে যদি ওই ব্ল্যাক বক্স যেটা আছে, এটাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে লাস্ট মোমেন্টের কনভারসেশন গুলোকে পরীক্ষা করা যায়। তদন্ত সাপেক্ষে মূল কারণটা বলা মুশকিল। বা কোনরকম পূর্ব ধারণার প্রেক্ষিতে একটা মতামত দেওয়াটাও ঠিক না।
তিনি বলেন, এখানে যেটা আমরা ফিল করতেছি, এই বিমানগুলো অনেক পুরোনো। মানে ২০০০ সালের পর প্রস্তুতকারী দেশ চীনই এটা ব্যবহার করে না। কিন্তু আমরা আমাদের বাহিনীতে এটা স্টোর করে রাখছি। আমাদের এই মানের প্লেন উড়ানো উচিত কিনা বা এটা যুদ্ধের জন্য সক্ষম কিনা, এটা দিয়ে আমাদের কোনো কাজে আসবে নাকি আমরা এটা আমাদের জন্য লায়াবিলিটি হবে ক্রাইসিসের সময়, সেটা বিবেচনার সুযোগ অনেক আগেই চলে গেছে। আমরা সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা গত ১৬ বছর ধরে প্রজেক্ট বেজ কেনাকাটা হয়েছে এবং মেইনটেনেন্সের দিকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, মেইনটেনেন্সের নামে কারচুপি বেশি হয়েছে। মেইনটেনেন্সের খাতে অনেক টাকা রাখা হয়েছে যে টাকাটা ব্যয় না করে অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণেই আমরা শুনি যে বিমান বাহিনীর প্রধান তিন হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন, তার তিন বছর কালে। এই সমস্ত বিষয়গুলো আমার মনে হয় তদন্তে আসা উচিত, সংস্কারে আসা উচিত। শুধু তদন্ত ও সংস্কারের মধ্যে আসলেই হবে না, শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে যে অনেক সময় কোন দুর্ঘটনার সঠিক তদন্ত হয় না বা তদন্ত হলেও সেটা জানতে পারে না, সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধনটা কি হয় বা হবে সেটাও কেউ জানতে পারে না। এই জিনিসগুলো আসলে একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট অথরিটির আন্ডারে চলে যাওয়া উচিত। এটা কোনো বাহিনীর নিজস্ব তদন্ত হইতে পারে না। বাহিনী তার নিজস্ব দল দ্বারা ব্যবস্থাপনা করতেছে, একটা বাহিনী পরিচালনা করতেছে। তার একটা ভুল ত্রুটি হচ্ছে, তার কারণে জীবনহানি হচ্ছে, যানমালেরর ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু তদন্ত করছে বাহিনী নিজস্ব সদস্য দিয়ে। তারা কখনোই তাদের নিজস্ব দলের দুর্বলতাটাকে প্রকাশ করবে না।
সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বাহিনী গড়ে তুলতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান নাসির। তিনি বলেন, প্রতিবেশী থেকে বা ভিন্ন দেশ থেকে যে আক্রমণের সম্ভাবনা আছে, সেটাকে বিবেচনা করে আমাদের আর্থিক সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। এবং সেই কাজটা কিন্তু হয় নাই।
সূত্রঃ https://www.facebook.com/share/1CCcdbkkV9/
রিফাত