
ছবিঃ সংগৃহীত
একসময় যাকে সহকারী হিসেবে দেখা হতো, সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন পরিণত হয়েছে একপ্রকার প্রতিদ্বন্দ্বীতে। চিকিৎসা জগতে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও মানবিক অন্তর্দৃষ্টি যেখানে অন্যতম মূল সম্পদ ছিল, সেখানে এখন এআই সেকেন্ডের মধ্যে রোগ নির্ণয় করে সেই দক্ষতাকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ডা. ফাওজি কাত্রাঞ্জির একটি ভিডিও নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—এই প্রযুক্তির যুগে পেশাদার চিকিৎসকদের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায়?
এটি শুরু হয় একটি সাধারণ চিকিৎসা দৃশ্যের মাধ্যমে—একজন অভিজ্ঞ পালমোনোলজিস্ট (শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ) একটি বুকের এক্স-রে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছেন। ছায়া ও রেখার মানে বোঝার জন্য তার চোখ ধীরে ধীরে ছবির ওপর ঘুরছে, যেন তিনি একটি মানচিত্র পড়ছেন, যার পাঠ তিনি বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় শিখেছেন। কিন্তু চোখের পলকে হাজির হয় এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী—না, কোনো তরুণ ডাক্তার নয়, এমনকি কোনো মানুষও নয়। এটি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সিস্টেম, যেটি লাখো ছবির ওপর প্রশিক্ষিত এবং সেকেন্ডের মধ্যে একই রোগ নির্ণয় করে ফেলে।
প্রথমে ভাবা হয়েছিল, এআই হবে শুধু একজন সহকারী। কিন্তু যখন সহকারীই হয়ে ওঠে প্রধান বিশেষজ্ঞ—আরও দ্রুত, আরও সাশ্রয়ী এবং কখনও কখনও আরও নির্ভুল—তখন প্রশ্ন ওঠে: তাহলে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে?
প্রথমদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছিল এআই কেবল সাধারণ কাজগুলোকেই প্রতিস্থাপন করবে—ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার সার্ভিস, এমনকি কিছু লেখালেখির কাজও। কিন্তু চিকিৎসা পেশাকে ধরা হচ্ছিল এমন একটি ক্ষেত্র, যা এতটাই জটিল, সংবেদনশীল এবং মানবিক, যে তা কখনোই মেশিন দ্বারা পুরোপুরি প্রতিস্থাপিত হবে না।
কিন্তু এখন সেই সীমারেখাতেও এআই প্রবেশ করছে। সম্প্রতি, মেটার সিইও মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা দেন যে, তাদের কোডিংয়ের ৫০% কাজ করবে এআই। সেই একই হুমকির মুখে এখন চিকিৎসকরাও।
চিকিৎসার ভবিষ্যৎ: মানবিক অন্তর্দৃষ্টি না মেশিনগত গতি?
ডা. ফাওজি কাত্রাঞ্জির কাছে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় শুধু এআই এর দক্ষতা নয়, বরং তা তার পরিচয় ও জীবনের পরিশ্রমকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তিনি বলেন, "এই কাজটা শুধু নিউমোনিয়া চেনার নয়, এটা বোঝার জন্য ২০ বছর সময় লেগেছে।" অথচ একটি মেশিন সেটি সেকেন্ডেই করতে পারে।
যদিও এখনো অধিকাংশ হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কারণে এআই সম্পূর্ণভাবে একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। চিকিৎসা লাইসেন্স, রোগীর সম্মতি এবং নৈতিক দিকগুলো এআই এর ব্যবহারকে সীমিত রাখছে।
ডা. ফাওজির ভাইরাল টিকটকে এক জন মন্তব্য করেন, “এআই যতই নির্ভুল হোক না কেন, সেটা সব সময় ১০০% সঠিক হবে না।” আরেকজন বলেন, “অতিরিক্ত খরচ হলেও আমি এআই-এর সঙ্গে একজন ডাক্তারকেই পাশে চাই।”
নতুন সহকর্মী, না ভবিষ্যতের বস?
তাহলে এআই কি ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে এসেছে, নাকি তাদের ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে? এই প্রশ্নটি শুধু চিকিৎসা নয়, বরং প্রতিটি দক্ষ পেশার মধ্যেই উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।
বর্তমানে ডা. ফাওজিরা হয়তো তাদের স্টেথোস্কোপ তুলে রাখছেন না, তবে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা প্রবল। এআই যতই কার্যকর হোক, মানুষের জীবন ও পরিচয় যখন যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপনের হুমকিতে পড়ে, তখন প্রযুক্তির অগ্রগতিও অনেকের কাছে প্রতারণার মতো মনে হয়।
ডা. ফাওজির কথায়, “মজা করে বলছি বটে, কিন্তু ভাবতে হচ্ছে—আমি এবার ম্যাকডোনাল্ডসে চাকরির জন্য আবেদন করব। ওদের কি স্টাফ দরকার?”
এই রসিকতা বাস্তবে পরিণত হবে কি না, তা নির্ভর করছে সমাজ কিভাবে মানবিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গ্রহণ করে তার ওপর।
ডা. ফাওজি কাত্রাঞ্জির একটি টিকটক ভিডিওতে দেখা যায় এআই কীভাবে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে এক্স-রে বিশ্লেষণ করছে, যা চিকিৎসা জগতে আলোড়ন তুলেছে। যদিও প্রযুক্তি কার্যকর ও সময় সাশ্রয়ী, অনেকেই বলছেন AI কখনোই মানবিক সহানুভূতি, অভিজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। চিকিৎসা ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই দুই ধরনের বুদ্ধিমত্তাকে কতটা ভারসাম্যপূর্ণভাবে একত্র করা যায় তার ওপর।
সূত্রঃ দ্যা ইকোনোমিক টাইমস
নোভা