ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

কৃষিতে নারীর শ্রম ॥ প্রয়োজন নিবন্ধন ও প্রণোদনা

নীলিমা জাহান

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ২১ জুন ২০২৪

কৃষিতে নারীর শ্রম ॥ প্রয়োজন নিবন্ধন ও প্রণোদনা

কৃষক পরিবারের নারীরা উদয়-অস্ত পরিশ্রম করেন

কৃষক পরিবারের নারীরা উদয়-অস্ত পরিশ্রম করেন। শুধু  তাই নয়- কখনো কখনো গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন। তাদের পরিশ্রম পরিবার প্রধান কৃষক পুরুষের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে পরিশ্রম বেশি হয়ে থাকে। কৃষক পরিবারে নারীরা ধানকাটা মৌসুমে নাওয়া খাওয়ার সময় পান না।  তবে পরিবারের সদস্যদের জন্য নিত্যদিন রান্না করে তিন বেলা খাবারের জোগান নারীরাই দেন। 
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘জ্ঞানের লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী, শস্য-লক্ষ্মী নারী,/ সুষমা-লক্ষ্মী নারী ওই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারী।/ শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালালো হাল,/ নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সু শ্যামল।/ নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই জল মাটি মিশে/ ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।’
যে নারী কৃষিতে শ্রম দেন, যে নারী আমাদের কৃষি, সমাজ ও সংসারকে মহিমান্বিত করেছেন জীবনের সবটুকু বিনিয়োগ দিয়ে; তার কষ্ট আসলেই এখনো অমানবিক। সমাজে সংসারে তাদের মর্যাদা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ জনপদে কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা অন্যতম নিয়ামক শক্তি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষি পরিবারে নারীরা ঘরে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন। তবে এখন বীজ সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটা কৃষি পরিবারে নাই বললেও চলে। কারণ প্রতি মৌসুমে ফসলের বীজ প্যাকেটজাত হয়ে বাজারের বিপণন হয়। 
তবে হাঁস, মুরগি পালন, গরু ছাগল পালন; গরুর দুধ দোহন, গরু মোটাতাজাকরণ, হাঁস-মুরগির ডিম ফোটানো, বসতবাড়িতে শাক-সবজি, ফল-ফুল চাষ, শীতল পাটি তৈরি, জ্যাম জেলি আচার, স্যুপ আমসত্ত্ব তালসত্ত্ব, আলুর কলার চিপস, চানাচুর তৈরি, ছাদ বাগান পরিচর্চা, জ্বালানি সংগ্রহ, কৃষি বনায়ন, সামাজিক বনায়নের সবগুলোতেই গ্রামের নারীরা সম্পৃক্ত। গ্রামের সাঁওতাল, উঁড়াও, গারোসহ নৃগোষ্ঠীর নারীরা মাঠে কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। 
শ্রম শক্তির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষি কাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত আছেন। যা দিন দিন আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যাপক তরুণী নিজেকে আধুনিক কৃষিতে আত্মনিয়োগ করছেন। পাশাপাশি এ দেশে তৈরি হচ্ছে উল্লেখযোগ্য কৃষি নারী উদ্যোক্তা।

ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর শ্রম ও অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী সর্বজনবিদিত।
কৃষিতে নারীর ভূমিকা মৌলিক। শ্রম জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী নারীদের কর্মসংস্থানের ৬০ ভাগই ঘটে কৃষিতে। বাংলাদেশের অনেক স্থানে কৃষি কাজে নারীদের প্রধান পেশা নির্দিষ্ট নেই। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যেমনÑ সাঁওতাল, চাকমা, গারো নারীদের বেশির ভাগেরই প্রধান পেশা কৃষি। কেবল শস্য কৃষি নয়, বরং মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, পশুপালন ইত্যাদি কৃষির নানাদিকে এ নারীদের বিচরণ দৃশ্যমান। গৃহভিত্তিক শাক-সবজি কৃষি উৎপাদন কাজেও নারীরা দিনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করে থাকে।

কিন্তু কৃষিতে নারীর এ অবদান খুব একটা স্বীকার করা হয় না। এমনকি কৃষক বলতে যাদের কথা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, সেখানে নারীর অবস্থান তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো, কৃষি উপকরণের জন্য কিংবা উৎপাদিত ফসল বিক্রির ক্ষেত্রেও নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। নারীরা কৃষি উৎপাদনের মূল কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সীমিত সংযোগের কারণে কৃষক হিসেবে নারীর স্বীকৃতি যেমন নেই, তেমনি কৃষিপণ্য উৎপাদনে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে নারী যে ভূমিকা পালন করে থাকে সেটিও স্বীকৃতির বাইরেই থেকে যায়।
আধুনিক কৃষি তথা কৃষিতে ডিজিটালাইজেশনেও বাংলাদেশের নারী কৃষকরা প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের বর্তমানে ১৪ শতাংশ নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং ৬৪ শতাংশ গ্রামীণ নারী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষাণীরা বিভিন্ন রকমের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারেও দিন দিন সচেষ্ট হচ্ছেন। তবে এখনো নারী কৃষি শ্রমিকদের কোনো নিবন্ধন নেই। এমনকি মজুরিও কাজের অনুপাতে যথার্থ নয়। কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে ১৯৮৪ সালে ‘কৃষিতে নারী’, ১৯৯৯ সালে ‘অন্ন জোগায় নারী’Ñএ স্লোগান নির্ধারিত হয়েছিল।
 এ ক্ষেত্রে নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, বেশি কাজে বেশি সম্মান স্বীকৃতি, সরকারি কৃষি কর্মকা-ে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া, কৃষি কাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কৃষাণীদের অগ্রাধিকার দেওয়াসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ এখন নীতি নির্ধারকের হাতে।

×