কর্মক্ষেত্রে নারীর চ্যালেঞ্জ
সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার সত্ত্বেও সমসংখ্যক নারী কতটা বিপন্ন অবস্থা মোকাবিলা করে সেটা বিভিন্ন সময় প্রতিভাতও হয়। এটা শুধু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন তারতম্য বিরাজমান। সীমাবদ্ধ সংসার থেকে পেশাগত আঙিনা পরবর্তীতে বৃহত্তর সামাজিক দৃশ্যপটে এমন চিত্র সহনীয় মাত্রায় থাকেই না। উন্নত বিশ্বের বহু ধনী দেশেও নারীদের অসাম্য-বৈষম্য দৃষ্টিকটু।
গত মার্চ মাসে কর্মজীবী নারীদের নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। ‘উইমেন বিজনেস অ্যান্ড দ্যা ল’ শিরোনামে যে কার্যক্রম চালানো হয় তাতেই বিসদৃশ্যতার চরম বিষয়টা সামনে চলে আসে। গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে ১৯০টি দেশের মধ্যে ৯৮টি রাষ্ট্রেই আছে পেশার ক্ষেত্রে সমপরিমাণ অর্থ প্রদান আইনগত বিধি। তার আগে প্রশ্ন থেকেই যায় বিশ্বের অর্ধেক দেশই এই সমতাভিত্তিক আইনের আওতাধীনই নয়।
২০২৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনটি ক্যাটাগরিতে এমন জরিপ চালানো হয়। তার মধ্যে রয়েছে বেতন-ভাতা, অভিভাবকের অধিকার ও কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা। দেশগুলো দুটি ক্যাটাগরিতে কম স্কোর পায়। শিশু সন্তান লালন পালন আর নিরাপত্তা বেষ্টনী। নারীদের সুরক্ষা বিষয়টিতে গুরুত্ব মানেই শারীরিক নিরাপত্তা। যেখানে অফিস-আদালতে হরহামেশাই নারীদের উত্ত্যক্ত করার ন্যক্কারজনক চিত্র সত্যিই আধুনিক সভ্যতার চরম পরিহাস ও নির্মম যাতনা।
শারীরিকভাবে নিরাপদ থাকার বিধি বিশ্বের ১৫৯টি দেশে বিদ্যমান বলে তথ্য-উপাত্তে উঠে আসে। সেখানে প্রতিভাত হয় মাত্র ৩৯টি রাষ্ট্রে এমন নিষেধাজ্ঞা পালন করা হয়। এখনো সংশ্লিষ্ট দেশের সিংহভাগ নারীর গণপরিবহনই তার প্রতিদিনের যাত্রা মাধ্যম। সেখানেই নারীরা লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে বেশি। শুধু তাই নয় যাদের হাতে ক্ষমতা রয়েছে তারা এমনসব ঘটনাকে আমলে পর্যন্ত নিচ্ছে না।
অর্থাৎ পথে ঘাটে, গণপরিবহনে নারী আদৌ নিরাপদে তার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছতে পারছে কি না তাও নাকি ধর্তব্যের মধ্যে আসেই না। সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে এসে কর্মস্থলে গমন করা সিংহভাগ নারী আসলে দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় বিব্রতকর অবস্থায় কর্মঘণ্টা পার করে। তেমন সংখ্যা কর্মজীবী নারীদের এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোও ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে এক প্রতিবেদন দৃশ্যমান করে। সেখানে পেশাগত অবস্থানে নারীদের হরেক চ্যাঞ্জেলও স্পষ্ট হয়।
অন্য পেশার ক্ষেত্রে নারীদের বেকারত্বের হার ৫.৯%। সেখানে পুরুষদের ২.৮%। প্রায়ই দ্বিগুণ। বয়স নিরিখে ১৫ বছরের কিশোরীদের বেকারত্বের হার ১৬.৫%। উদীয়মান কিশোরদের হার যেখানে অর্ধেক। আর শ্রমের ধরন, সময় এবং অন্যকিছুর মধ্যে তারতম্য না থাকলেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এমনিতে দেশ-বিদেশে শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের তুলনায় নিতান্ত কম।
সেখানে সমসংখ্যক নারীরা কত শোষণ আর ফারাকের শিকার তা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেও না। থাকার কথাও নয়। প্রতি ঘণ্টার নিরিখে পুরুষরা নাকি ৩৫% টাকা বেশি তার সহকর্মী নারীর শ্রমিকের তুলনায় পায়। অসহনীয় এক দুঃসহ বিসদৃশ চিত্র তো বটেই। আর বয়স ভিত্তিতে নারী পুরুষের আয় বৈষম্য এক অনির্ধারিত মজুরির চরম বিপাক।
নারীদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন ফারাক আরও দৃষ্টিকটুভাবে বাড়তে থাকে। লিঙ্গ বৈষম্যেই আয়ের তারতম্যের মূল বিষয় যা পেশাগত বিভাজন বাড়ায়। সঙ্গত কারণে বেতন বৈষম্যকে মেনে নিয়েও নারী কর্মজীবীদের পেশাগত সময় পার করা এক প্রচ- দুর্বিপাক ছাড়া আর কিছুই নয়। তেমন অসম ব্যবস্থাপনায়ও নারীদের কোনো ওজর আপত্তি থাকেই না কিংবা টেকেও না।
বৈষম্যপীড়িত কর্মসংস্থানে যোগ দিতেও তেমন কোনো অনীহা দেখাই যায় না। সত্যিই নিদারুণ এক কর্মযাতনা তো বটেই। আবার পূর্ণকালীন চাকরিতে অবস্থান করা নারীর সংখ্যাও পুরুষের তুলনায় কমই। বরং খ-কালীন যে কোনো পেশায় নারীরা সংযুক্ত হয়ে যায় স্বইচ্ছায়, অবলীলায়।
আরও এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় বিশেষ করে পোশাক শিল্প-কারখানায় পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় নারী শ্রমিকের বেতন- ভাতার তারতম্য ৩০% পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়ে থাকে। কর্মঘণ্টায় নারীরা নাকি স্বাভাবিকভাবে তার পুরুষ সহকর্মীর থেকে ২ ঘণ্টা রীতিমতো পিছিয়েও থাকে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে কোনো নারীকে সবার আগে তার গৃহকর্ম এবং সংসার সামলিয়ে পেশাগত জায়গায় ছুটতে হয়।
সেখানে তাকে কাকডাকা ভোরে উঠে পারিবারিক সার্বিক দায়-দায়িত্ব পালন করে সেখান থেকেই কাজের সময় খুঁজে নিতে হয়। আর পুরুষ কর্তা ব্যক্তিটি সকালে ঘুম থেকে উঠেই তৈরি নাশতা পেয়ে যান। শুধু ¯œানাহার সেরেই তাকে কর্মক্ষেত্রে ছুটতে হয়। আর মহিলা কর্মজীবীর যদি শিশু সন্তান কিংবা বয়োবৃদ্ধ কোনো অসুস্থ সদস্য বাসায় থাকেন তা হলে তো তাকে সময় বিবেচনাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়।
পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দরজা তার জন্য খোলাও থাকে না। কর্মঘণ্টায় পিছিয়ে যাওয়ার কারণে নারীদের পদোন্নতিও সেভাবে দৃশ্যমান হয়ই না। তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে এমন বৈষম্য সমস্যাকে উত্তরণের পথও নির্দেশিত হয়ে আসছে। বেতন-ভাতায় বৈষম্য কমিয়ে আনলে নারীদের কর্মস্পৃহা বাড়বে এবং তারা যথাসময়ে নির্দিষ্ট কাজটি করতে সচেতন সাবধানতার আশ্রয় নেবে।
লাভটা একচেটিয়া নারী কর্মজীবীর হবে না। বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে এর ইতিবাচক প্রভাব। লিঙ্গ বৈষম্য সেটা পারিবারিক, কর্মস্থল, গণপরিবহন, যাত্রাপথ যেখানেই হোক না কেন তাকে সহনীয় অবস্থায় ফেরাতে না পারলে যথার্থ উন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে।