ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

‘মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি’

রুনা তাসমিনা

প্রকাশিত: ০১:২১, ২০ অক্টোবর ২০২৩

‘মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি’

ঘরকন্যা শব্দটি একসময় গৃহের যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করা গৃহিণীর জন্য ব্যবহার হতো

ঘরকন্যা শব্দটি একসময় গৃহের যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশোনা করা গৃহিণীর জন্য ব্যবহার হতো। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবন-যাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। গৃহকন্যারা অফিস আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় রাখছেন মেধার সাক্ষর। সংসার সামলে তৈরি করছে নিজের একটি জগত। সে জগতেও চলে প্রতিযোগিতা। এগিয়ে যাওয়ার দৌড়। কিন্তু এই দৌড়ের প্রতিটি পদক্ষেপ দিতে হয় অত্যন্ত সাবধানে। যার জন্য নিজেকেই তৈরি করে নিতে হয় সেই পদক্ষেপের ধরন। প্রতিটি সৃজনশীল কাজই এক একটি শিল্প। সৃজনশীল মানুষ তাঁর মনের চিত্রের বহির্প্রকাশ ঘটান কাজের মধ্য দিয়ে। তেমনই একজন অপ্রতিরোধ্য নারী জামিলুন নাহার তনয়া। যিনি ২০২ সালে ‘মার্কস ডেজার্ট কুইন প্রতিযোগিতায়’ সারাদেশের মধ্যে প্রথম কুইন হয়ে মুকুট পরেছিলেন। 
জামিলুন নাহারের বাড়ি বরিশাল। কীর্তনখোলা, গৌরনদীর বহমানতা যেন তনয়ার রক্তে মিশে আছে। যে মেয়ে নদীর বহমানতার সঙ্গে বেড়ে ওঠে, তাকে ঠেকানোর সাধ্য কী আছে! তনয়ার বেলায়ও ঠিক তেমনি। বাংলাদেশের মেয়েরা  শৈশব থেকেই গৃহিণী হয়ে ওঠে নিজের অজান্তে। রান্নাবাটি খেলতে খেলতে নিজের অজান্তে শখ জাগে রান্নার। তনয়ার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রকৃতির সঙ্গে বাঙালি মেয়ের বন্ধন অষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। চোখে সেই রূপ তুলে নিয়ে ঝুঁকলেন ক্রাফটস’র দিকে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রাফটিংয়ের সঙ্গে শখটা ফটোগ্রাফির দিকে ফিরে যায়। রান্নার শুরুটা  অনেকটা শখের বশে করা। করোনাকালীন সময়ে যখন পুরো দেশ লকডাউন, তখন অনেকেই রান্নার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। তনয়াও সেই সময় অনেকটা হুট করে একটা অনলাইন বেকিং কোর্স দিয়ে রান্নার প্র্যাকটিস শুরু করেন ঘরেই। যেহেতু ক্রাফটিং ভালোবাসেন তাই কেক আর ডেজার্টে ক্রাফটিংয়ের আর্ট জুড়ে দিতেন। কোনো ডেজার্টের নতুন রেসিপি পেলেই বানিয়ে ফেলতেন। বাসার সবাই উৎসাহিত করতেন সবসময়। তাদের সবার উৎসাহে শুরু হয় তাঁর ‘কেক অ্যান্ড কো’ পেজের যাত্রা। 
শুরুতে কাছের মানুষরা সবাই তাঁর কাছ থেকে কেক নিতেন। ধীরে ধীরে শখ পরিণত হয় পেশায়। তিনি বেকিং নিয়ে এডভান্স ও বেসিকের অনেক শর্ট কোর্স করেছেন। কখনো  অনলাইনে কখনো সরাসরি। বেকিং লেভেল ওয়ান অ্যান্ড টু সম্পন্ন করেন আইটিআইসিএ থেকে। ‘মার্কস ডেজার্ট কুইন প্রতিযোগিতা’  ছিল তাঁর জীবনের প্রথম রিয়ালিটি শো। তবে এর আগে ফুডপ্লেন্টিং-এর ওপর একটা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায়। স্নাতকোত্তর করেন মার্কেটিং নিয়ে। চার বছর শিক্ষকতা করেন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে।

বহির্বিশ্বে কর্মজীবী নারীর বিষয়টি খুব স্বাভাবিক হলেও এই একুশ শতকে এসেও আমাদের দেশে এখনো তা পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তাই আমাদের দেশে ঘরের বাইরে কাজ করার জন্য মেয়েদের স্বাধীনতা থাকলেও নানা সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের। ঘরের বাইরে নিজের কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে তনয়া বলেন, বর্তমানে নারীরা কর্মক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে সংসারের সবকিছু সামলে ঘরে বাইরে কাজ করা বরাবরই কষ্টকর। তবুও ইচ্ছা শক্তিতে নারীরা সফল হয়ে উঠতে পারছে। একজন নারীর সফল হওয়ার পেছনে অনেক আত্মত্যাগ থাকে। অনেক চ্যালেঞ্জও পার করতে হয়।

প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর পরিবারের সবার উৎসাহ আর সহযোগিতায় অনেক এগোতে পারছি। ছোটো পরিসরে বেড়ে ওঠা আমার কেক ও ডেজার্ট বিজনেস একটু একটু করে বড় হচ্ছে। আমার এই উদ্যোগকে অনেকদূর নিয়ে যেতে চাই এটাই আমার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণে যে ‘মার্কস ডেজার্ট কুইন কম্পিটিশন’ আমার পথটা উজ্জ্বল করে তুলবে কখনো ভাবিনি।
মার্কস ডেজার্ট কুইন কম্পিটিশনে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার নারী অংশগ্রহণ করেন। প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক কেন্দ্র থেকে দশ জন বাছাই হয়। সেই দশ জন থেকে একজন কুইন নির্বাচিত হন। এভাবে সারাদেশ থেকে এক শ’ জন কুইনকে নিয়ে শুরু হয় কেন্দ্রীয় প্রতিযোগিতা। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কিচেন খ্যাত মুন্সীগঞ্জের ঢালী’র আম্বার নিবাস রিসোর্টে। সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা দেওয়া হয় রাজকীয়ভাবে।
জামিলুন নাহার তনয়ার ভাষায়, লাল গালিচা সংবর্ধনা, ওয়েলকাম ড্রিংকস, ফুল, ঘোড়া সবই ছিল এই আয়োজনে। আমরা অভিভূত হয়েছি আয়োজন দেখে। ছিল মিউজিক নাইট। প্রথম দুদিন আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের দেওয়া আন্তর্জাতিকমানের ট্রেনিং। ওই ট্রেনিংয়ের ওপর ভিত্তি করে আমরা প্র্যাকটিস করি দুদিন। এরপর, এই রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় ডেজার্ট তৈরি প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম রাউন্ডে পঞ্চাশ জন বাদ পড়ে। দ্বিতীয় রাউন্ডে বাকি পঞ্চাশ জন থেকে বাছাই হয় টপ টেন। প্রতিমুহূর্তে ঝরে পড়ার আশঙ্কা। কেউই হারতে চাই না। প্রত্যেকের মধ্যে কুইন হওয়ার অদম্য ইচ্ছে। তবুও পিছিয়ে যেতে হচ্ছে। এতদূর এসে বাদ পড়া যে কী কষ্টের! সেরা দশে এসে নিজেকে দেখলাম স্বপ্ন থেকে মাত্র কয়েক স্টেপ দূরে! এই জায়গায় নিজেকে দেখে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর স্বপ্নটা আরও বেড়ে গেল। আমাদের দশ জনকে নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। শুরু হয় কাউন্টডাউন প্রতিযোগিতা। তারপর একটু একটু করে পৌঁছে গেলাম একদম স্বপ্নের সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। 
এলো সেই দিন, ২ অক্টোবর ২০২২। ফাইনাল ফলাফলে যখন আমার নাম ঘোষণা করা হলো, তখন মনে হচ্ছিল আমি আসলেই স্বপ্ন দেখছি! এ এক আশ্চর্য প্রাপ্তি। রামপুরা ভেন্যুর ‘কুইন’ হব এই আশা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। ঘরে ফিরি মার্কস ডেজার্ট কুইন প্রতিযোগিতার প্রথম ‘কুইন’ হয়ে মাথায় জয়ের মুকুট পরে। এটা বলা যায় ধৈর্য এবং ক্রমাগত লেগে থাকার ফল।

×