
আলী শেখ (বামে) বলেন, শুরুতে তিনি কাগজপত্র দেখালেও কর্তৃপক্ষ সেগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ছবিঃ বিবিসি
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে দিল্লি ও তার আশেপাশে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্ত করতে স্থানীয় প্রশাসনের ‘ভেরিফিকেশন ড্রাইভে’ শত শত মানুষকে আটক করা হয়েছে।
গুরগাঁও শহরে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট আর আকাশচুম্বী ভবনের পাশে বসবাসরত গরিব শ্রমিকদের ওপর এ অভিযান চালানো হয়। তাদের অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের শনাক্ত করার জন্য এই অভিযান চালাচ্ছে। তবে আটক ব্যক্তিরা বলছেন, তাদের বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের মারধর করেছে এবং আটক রেখে হয়রানি করেছে।
১৫ বছর ধরে গুরগাঁওয়ে কাজ করে আসা মজদুর আথার আলী শেখ বলেন, “আমার ভোটার কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র সব ছিল, তবু তারা বললো এগুলো নকল। আমি ছয় দিন আটকে ছিলাম, জানতাম না কী হবে আমার।”
এই ঘটনায় বহু শ্রমিক রাতারাতি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ ঘরবাড়ি, চাকরি এমনকি পরিবার পর্যন্ত ফেলে রেখে গেছে নিরাপত্তার অভাবে।
একইসঙ্গে শহরের উচ্চবিত্ত এলাকাগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও গৃহকর্মীদের অনুপস্থিতিতে আবর্জনা জমে যাচ্ছে এবং বাসিন্দারা দুর্ভোগে পড়ছেন।
টাবাসসুম বানো নামের এক বাসিন্দা বলেন, “আমাদের গৃহকর্মী ও তার স্বামী যিনি ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন—দুজনেই পালিয়ে গেছে। এখন আমরা বিপাকে পড়েছি।”
গুরগাঁওয়ের পুলিশ জনসংযোগ কর্মকর্তা সন্দীপ কুমার জানান, অভিযানে ২৫০ জনকে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে মাত্র ১০ জনকে অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, “ধর্ম বা শ্রেণির ভিত্তিতে কাউকে লক্ষ্য করা হয়নি। কাউকে নির্যাতনও করা হয়নি।”
তবে মানবাধিকারকর্মী ও শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, অভিযানের পেছনে ভাষা, ধর্ম ও গরিবি বড় ভূমিকা রাখছে।
অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নের নেতা আকাশ ভট্টাচার্য বলেন, “বেঙ্গলি ভাষায় কথা বলেন, মুসলিম নাম আর ঝুপড়িতে থাকেন—এই তিনটি মানদণ্ডই কাউকে সন্দেহভাজন বানিয়ে দিচ্ছে।”
আরও উদ্বেগের বিষয়, যাচাইয়ের পর কেউ বৈধ প্রমাণিত হলেও তাকে কোনও সরকারি সনদ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে তারা ভবিষ্যতে আবার একই প্রক্রিয়ার শিকার হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে অনেকেই প্যান কার্ড, ভোটার আইডি, আধার কার্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্র বালিশের নিচে রেখে ঘুমাচ্ছেন, যাতে হঠাৎ পুলিশের অভিযানে হাতের নাগালে থাকে।
দিল্লির ‘জয় হিন্দ ক্যাম্প’ এলাকায় বসবাসকারী রাবিউল হাসান বলেন, “আমরা আগে থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছি। এখন এই ভয়াবহ আতঙ্ক যুক্ত হয়েছে।”
ওই এলাকায় তিন সপ্তাহ আগে আদালতের নির্দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। শহরের পরিকল্পনা সংস্থার স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও জায়গাটি ‘অবৈধ দখল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ৪০০ বাসিন্দা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।
স্থানীয় বাসিন্দা বাইজান বিবি বলেন, “খাবার পঁচে যাচ্ছে, শিশুরা কাঁদছে, আর রাতে মশায় ঘুমোতে দিচ্ছে না। এমন অবস্থায় মাঝে মাঝে মনে হয়, ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকলেও ভালো, অন্তত একটা ফ্যান তো থাকতো।”
এই ঘটনার পেছনে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি নতুন নির্দেশনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে সব রাজ্যকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে ‘অবৈধ বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের’ অভিবাসীদের শনাক্ত ও ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সমালোচকদের মতে, এই নির্দেশনায় কারা সন্দেহভাজন হিসেবে গণ্য হবে সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। ফলে নির্বিচারে গরিব ও সংখ্যালঘু মানুষদের হয়রানি করা হচ্ছে।
সূত্রঃ বিবিসি
নোভা