
ছবি: সংগৃহীত
দিল্লির নিকটবর্তী গাজিয়াবাদে অবস্থিত একটি বিলাসবহুল দু’তলা ভবন, বাইরে চারটি কূটনৈতিক নম্বর প্লেটযুক্ত গাড়ি, ভবনের সামনে ঝলমলে একটি নামফলক—‘গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়েস্টার্কটিকা’ এবং ‘এইচ ই এইচ ভি জৈন, অনারারি কনসাল’—সবকিছুই যেন নিখুঁত এক দূতাবাসের ছদ্মবেশ! তবে বাস্তবে সেটি ছিল এক প্রতারণার কারখানা, যা সাত বছর ধরে প্রকাশ্যেই পরিচালিত হচ্ছিল।
প্রতারক হর্ষবর্ধন জৈন গ্রেফতার
গাজিয়াবাদ ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি শহর এবং জেলা। এটি ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লির পূর্বে অবস্থিত। উত্তর প্রদেশের পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (STF) সম্প্রতি এই ভুয়া দূতাবাসের সন্ধান পায় এবং মূল অভিযুক্ত হর্ষবর্ধন জৈনকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ, জৈন বিদেশে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাকরির নাম করে প্রতারণা চালাতেন। এছাড়াও, জাল কূটনৈতিক নথিপত্রের মাধ্যমে অর্থপাচারের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
STF-এর অভিযানে উদ্ধার হয় ৪৪ লাখ টাকা নগদ, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, ১৮টি কূটনৈতিক নম্বর প্লেট, বিলাসবহুল ঘড়ির সংগ্রহ, ১২টি মাইক্রোনেশনের ‘ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট’, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাল সিলসহ ৩৪টি দেশের জাল সিল।
কূটনৈতিক ছদ্মবেশে প্রতারণা
জৈনের প্রতারণার পরিকল্পনা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। গাজিয়াবাদের একটি ভাড়া করা ভবনে তিনি ‘ওয়েস্টার্কটিকা’র কনস্যুলেট হিসেবে পরিচিত এক অফিস চালাতেন। অফিসের বাইরে ছিল ভারতের ও আন্টার্কটিকা মহাদেশের এক ক্ষুদ্র দেশ (বিশ্বের কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি) ওয়েস্টার্কটিকার পতাকা। অফিসের ভেতরে ছিল সম্পাদিত ছবি, যেখানে হর্ষবর্ধন জৈনকে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।
পুলিশের তদন্ত অনুযায়ী, ২০১৭ সাল থেকে জৈন এই দূতাবাসের রূপে প্রতারণার কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের আকৃষ্ট করতে ‘ভাণ্ডারা’সহ নানা দাতব্য কর্মসূচিরও আয়োজন করতেন।
পুরোনো ইতিহাসেও সন্দেহজনক কার্যকলাপ
জৈনের অতীতও সন্দেহজনক। ২০১১ সালে একটি স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহারের জন্য তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। এছাড়া, তার সঙ্গে বিতর্কিত ‘গডম্যান’ চন্দ্রস্বামী ও সৌদি অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগির সম্পর্ক থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চন্দ্রস্বামী এক সময় ভারতের তিন প্রধানমন্ত্রী—পি ভি নরসিমা রাও, চন্দ্রশেখর ও ভি পি সিং—এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। ১৯৯৬ সালে তাকে গ্রেফতারও করা হয়। চন্দ্রস্বামী রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে অর্থায়নের অভিযোগেও অভিযুক্ত ছিলেন।
‘ওয়েস্টার্কটিকা’র বারন হয়ে ওঠা
জৈনের পরিচয় ছিল ‘এইচ.ই. এইচ ভি জৈন, কনসাল জেনারেল অব দ্য গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়েস্টার্কটিকা’। উল্লেখ্য, ওয়েস্টার্কটিকা একটি তথাকথিত মাইক্রোনেশন, যা ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর এক অফিসার ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত নয়।
ওয়েস্টার্কটিকার ইনস্টাগ্রাম পেজে এই ‘দূতাবাস’কে ‘নয়াদিল্লিতে কনস্যুলেট জেনারেল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। পোস্টে লেখা ছিল, ‘বারন এইচ ভি জৈনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই কনস্যুলেট প্রতি বছর পাঁচবার ১,০০০ জনের বেশি মানুষকে খাদ্য বিতরণ করে।’ পোস্টে গাজিয়াবাদ ভবনের ছবিও ছিল।
ওয়েস্টার্কটিকা আসলে কী?
ওয়েস্টার্কটিকা দাবি করে, এটি ৬.২ লাখ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে গঠিত একটি দেশ, যা অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত। এটির নাগরিক সংখ্যা ২,৩৫৬ হলেও কেউ সেখানে বসবাস করে না। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন ও অ্যান্টার্কটিকার বিষয়ে সচেতনতা ছড়াতে কাজ করে। তাদের নিজস্ব পতাকা, মুদ্রা ও উপাধি রয়েছে—যা বিশ্বের কোনো সরকার স্বীকৃতি দেয়নি।
এ ধরনের মাইক্রোনেশন বিশ্বের বহু জায়গায় রয়েছে, যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করলেও বাস্তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি।
সূত্র: এনডিটিভি।
রাকিব