ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২

দ্রুজ কারা? কেন তাদের বাঁচাতে সিরিয়ায় হামলা করল ইসরায়েল?

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ১৮ জুলাই ২০২৫

দ্রুজ কারা? কেন তাদের বাঁচাতে সিরিয়ায় হামলা করল ইসরায়েল?

ছবিঃ সংগৃহীত

সিরিয়ার সার্বভৌমত্বে সরাসরি আঘাত করে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এই হামলার কারণ হিসেবে ইসরায়েল জানায়, তারা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—কারা এই দ্রুজ সম্প্রদায়? কেনইবা তাদের সুরক্ষার কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের সুর তুলছে তেলআবিব?

সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় আসাদবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম। এই গোষ্ঠীর নেতা আহমেদ আল সারা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। ইসলামপন্থী বিদ্রোহী নেতা হয়েও সারা কিছুটা উদারপন্থী মনোভাব দেখান এবং পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নেন।

কিন্তু তারপরও সম্প্রতি ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লক্ষ্য করে হামলা চালায়। ইসরায়েল জানায়, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সুদাইদা প্রদেশে দ্রুজ সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বেদুইন উপজাতিদের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষের জের ধরেই তারা এই হামলা চালিয়েছে।

কে এই দ্রুজ সম্প্রদায়?
দ্রুজরা একটি আরব ধর্মীয় গোষ্ঠী, যাদের মোট সংখ্যা বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০ লাখ। মূলত সিরিয়া, লেবানন ও ইসরাইলের পাহাড়ি অঞ্চলে তাদের বসবাস। গবেষণা বলছে, দ্রুজদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন উত্তর-পূর্ব তুরস্ক, দক্ষিণ-পশ্চিম আর্মেনিয়া ও উত্তর ইরাক সীমান্ত এলাকার অধিবাসী। ৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরে ইসলামি দর্শনের একটি শাখা হিসেবে দ্রুজ ধর্মের সূচনা হয়। হামজা বিন আলী ও আদ-দারাজিকে এই ধর্মের প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই ধর্মের মূল অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, আল হাকিম বি আমর আল্লাহ নামের ফাতেমীয় শাসক ছিলেন তাদের ধর্মের 'অন্তর্নিহিত' ইমাম। তাঁর মৃত্যু বা অন্তর্ধানের পর মিশরে এই ধর্ম নিষিদ্ধ হলেও তা লেবানন, সিরিয়া ও আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বাইরের ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিয়ে ও নতুন ধর্মান্তরিতদের গ্রহণ নিষিদ্ধ—এমন কঠোর নিয়ম মেনেই তারা টিকে আছেন।

ইসরায়েলের দ্রুজ সম্পর্ক ও দায়বদ্ধতা
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়, যেখানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার দ্রুজ বসবাস করেন। যদিও তাদের অধিকাংশই নিজেদের এখনো ‘সিরিয়ান’ বলে পরিচয় দেন এবং ইসরায়েলি নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

অন্যদিকে, ইসরায়েলে বসবাসরত প্রায় ১.৩ লাখ দ্রুজ নাগরিক ১৯৫৭ সাল থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত থাকেন। তাই তেলআবিব সরকার দ্রুজদের সঙ্গে ‘ঐতিহাসিক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক’-এর দাবি করে থাকে।

সুদাইদার সংঘর্ষ ও ইসরায়েলের হামলা
সিএনএনের বরাতে জানা যায়, গেল সপ্তাহে সিরিয়ার সুদাইদা শহরে দ্রুজ বাহিনী ও বেদুইন উপজাতিদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন নিহত হন। এরপর সিরিয়া সরকার সেখানে সেনা মোতায়েন করলে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়, যাতে সরকারি বাহিনীর অন্তত ১৮ জন সদস্য নিহত হন।

পরিস্থিতির মধ্যে ইসরায়েল সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ‘নিরস্ত্রীকরণ এলাকা’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, যা সিরিয়া সরকার প্রত্যাখ্যান করে।

রাজনৈতিক বিভাজনের আশঙ্কা
সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল সারা দ্রুজদের অস্ত্র সমর্পণ করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অধীনে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দ্রুজরা তা প্রত্যাখ্যান করে রাজনৈতিক বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছে।

সবশেষে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—ইসরায়েল কি সত্যিই দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করছে? নাকি এই ‘সুরক্ষা’র নামে আবারও এক ভঙ্গুর অঞ্চলে বিভক্তি ও সংঘাতের বীজ বপন করছে?

ইমরান

×