ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনা: ককপিট অডিওতে মিললো নতুন রহস্য

প্রকাশিত: ০১:২৩, ১৩ জুলাই ২০২৫

এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনা: ককপিট অডিওতে মিললো নতুন রহস্য

জুন মাসে ভারতের আহমেদাবাদে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হওয়া এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৭১–এর প্রাথমিক তদন্তে এক চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে, যা ২৬০ জনের প্রাণহানির এই ঘটনাকে আরও রহস্যজনক করে তুলেছে।

দুর্ঘটনার কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার (১২ বছরের পুরনো) বিমানের দুইটি ফুয়েল-কন্ট্রোল সুইচ হঠাৎ করে “কাট-অফ” পজিশনে চলে যায়, যার ফলে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং বিমানটি সম্পূর্ণ শক্তিহীন হয়ে পড়ে। সাধারণত এই “কাট-অফ” সুইচ ল্যান্ডিংয়ের পরেই বন্ধ করা হয়।

ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে শোনা যায়, এক পাইলট আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করছেন, “তুমি কাট-অফ করেছো কেন?”, আর জবাবে বলা হয়, “আমি করিনি।” তবে কে কী বলেছেন, তা অডিও রেকর্ডিংয়ে স্পষ্ট নয়। উড্ডয়নের সময় কপাইলট বিমানটি উড়াচ্ছিলেন এবং ক্যাপ্টেন মনিটর করছিলেন।

সুইচ দুটি আবার স্বাভাবিক ইন-ফ্লাইট পজিশনে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইঞ্জিন রিলাইট শুরু হয়। দুর্ঘটনার সময়, একটি ইঞ্জিন পুনরায় শক্তি ফিরে পাচ্ছিল, অন্যটি তখনও সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার হয়নি।

মাত্র এক মিনিটেরও কম সময় আকাশে ছিল বিমানটি। এটি আহমেদাবাদের ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এখন এটি ভারতের অন্যতম রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি।

তদন্তে যুক্ত রয়েছেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, বোয়িং, জেনারেল ইলেকট্রিক, এয়ার ইন্ডিয়া, ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা।

তদন্তকারীরা বলছেন, এই ধরনের সুইচ সাধারণত একটি স্টপ-লক ব্যবস্থায় লক করা থাকে, যা আকস্মিকভাবে পরিবর্তিত হওয়া প্রায় অসম্ভব করে তোলে। এদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ১৯৫০ এর দশক থেকে চলে আসছে, এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য।

একজন কানাডাভিত্তিক বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারী বিবিসিকে বলেন, “এক হাত দিয়ে একসাথে দুইটি সুইচ টানা প্রায় অসম্ভব, ফলে একে দুর্ঘটনাজনিত বলা কঠিন।”

অহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির সাবেক তদন্তকারী শ’ন প্রুচনিকি বলেন, “যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুল করে সুইচ বন্ধ করে থাকে, তাহলে প্রশ্ন উঠে—কেন?”

তিনি আরও বলেন, “বিমানটি উড্ডয়নের সময় কোনো সমস্যা দেখা যায়নি, এবং পাইলটদের কথাবার্তায়ও কোনো বিভ্রান্তির ইঙ্গিত ছিল না। এমন ভুল সাধারণত কোনও অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ঘটে।”

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ডের (NTSB) সাবেক ম্যানেজিং ডিরেক্টর পিটার গ্যোলজ বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে একজন পাইলট মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্বালানির সুইচ বন্ধ করে দিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “কেবল একটি মন্তব্য দিয়ে কিছু বোঝা যায় না। ভয়েস রেকর্ডার থেকে আরও কিছু পাওয়া যাবে—কে সুইচ অফ করেছিলেন, কে পুনরায় চালু করেন, তা জানাটা জরুরি।”

গ্যোলজ আরও বলেন, “সঠিকভাবে কণ্ঠস্বর চিহ্নিত না করা পর্যন্ত রহস্য ঘনীভূতই থাকবে। সাধারণত, যারা পাইলটদের ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা এই ধরণের রিভিউতে সহায়তা করে থাকেন।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ককপিটে ভিডিও রেকর্ডার থাকলে—যেমনটি NTSB দীর্ঘদিন ধরে সুপারিশ করে আসছে—তাহলে দেখা যেত কার হাত সুইচের ওপরে ছিল।

দুর্ঘটনার আগের দিন দুই পাইলটই আহমেদাবাদে পৌঁছান এবং যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ফ্লাইটের আগে তাদের ব্রেথালাইজার পরীক্ষায় কোনো অসঙ্গতি পাওয়া যায়নি।

একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তদন্তকারীদের নজর কেড়েছে। ২০১৮ সালে মার্কিন FAA (Federal Aviation Administration) একটি বুলেটিন প্রকাশ করে, যেখানে উল্লেখ ছিল যে কিছু বোয়িং ৭৩৭ বিমান ফুয়েল সুইচের লকিং ফিচার নিস্ক্রিয় অবস্থায় ইনস্টল করা হয়েছে। যদিও এটি নিরাপত্তা ঝুঁকি বলে বিবেচিত হয়নি, ফলে বাধ্যতামূলক মেরামতের নির্দেশনা (Airworthiness Directive) দেওয়া হয়নি।

বোয়িং ৭৮৭-৮–এ একই সুইচ ডিজাইন ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার VT-ANB ছিল। যেহেতু এটি কেবল একটি পরামর্শ ছিল, তাই এয়ার ইন্ডিয়া ওই পরীক্ষা করেনি।

এ নিয়ে প্রুচনিকির প্রশ্ন: “যদি লকিং ফিচার নিস্ক্রিয় থাকে, তাহলে কি সুইচ এমনিতেই অফ হয়ে যেতে পারে? যদি পারে, তবে এটি গুরুতর সমস্যা। যদি না পারে, তাহলে সেটাও স্পষ্ট করা জরুরি।”

তবে গ্যোলজ বিষয়টিকে ততটা গুরুতর মনে করছেন না: “আমি এমন কোনও অভিযোগ শুনিনি। পাইলটরা সাধারণত এমন বিষয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেন।”

ভারতের বিমানের দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরোর প্রাক্তন তদন্তকারী ক্যাপ্টেন কিশোর চিন্তা বলেন, “ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল ইউনিট থেকে কি সুইচ চালু বা বন্ধ হওয়া সম্ভব? যদি হয়, তবে এটি বিপজ্জনক বিষয়।”

তদন্তে জানা গেছে, বিমানে ব্যবহৃত জ্বালানির নমুনা সন্তোষজনক ছিল, ফলে জ্বালানি দূষণের সম্ভাবনা বাদ পড়েছে। এছাড়া বোয়িং ৭৮৭ বা GE GEnx-1B ইঞ্জিনের জন্য কোনো সতর্কতা জারি করা হয়নি।

দুর্ঘটনার সময় র‌্যাম এয়ার টারবাইন (RAT) স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলা হয়ে যায়, যার মাধ্যমে বোঝা যায় দুই ইঞ্জিনই একসাথে ব্যর্থ হয়েছিল। এটি বিমানের একটি ছোট্ট প্রপেলার যা জরুরি অবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

একজন অভিজ্ঞ বোয়িং ৭৮৭ পাইলট বলেন, “টেকঅফের সময় ল্যান্ডিং গিয়ার রিট্র্যাক্ট করতে সাধারণত আট সেকেন্ড লাগে। কিন্তু যখন দুই ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যায়, তখন পাইলট স্তব্ধ হয়ে যায়, একমাত্র চিন্তা থাকে—বিমানটি কোথায় নামানো যায়।”

প্রুচনিকির ভাষ্য অনুযায়ী, “পাইলটরা ইঞ্জিন রিস্টার্টের চেষ্টা করেছিলেন। বাম ইঞ্জিন একটু আগে চালু হলেও ডানদিকের ইঞ্জিন যথেষ্ট সময় পায়নি। ফলে শক্তি ফিরে আসেনি।”

দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের জন্য এটি হৃদয়বিদারক অপেক্ষা। ইমতিয়াজ আলী, যিনি তার ভাই, ভাবি ও দুই শিশুসন্তানকে হারিয়েছেন, বলেন, “রিপোর্ট পড়ে মনে হয়েছে শুধু যন্ত্রপাতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে, আসল ঘটনা পরিষ্কার হয়নি।”

“আমরা শুধু জানতে চাই কী ঘটেছিল। আমাদের শোক কিছুতেই বদলাবে না, কিন্তু অন্তত কিছু উত্তর তো পেতে পারি,”— বলেন তিনি।

Jahan

×