ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ট্রাম্প মোদি দ্বন্দ্ব: সীমিত সমঝোতা না কি ব্যর্থতা

প্রকাশিত: ২০:০১, ২ জুলাই ২০২৫

বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ট্রাম্প মোদি দ্বন্দ্ব: সীমিত সমঝোতা না কি ব্যর্থতা

৯ জুলাইয়ের সময়সীমা ঘনিয়ে এলেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের নির্ধারিত এই সময়সীমার আগে আলোচনা চলছে জোরকদমে, কিন্তু চুক্তির পথ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

যদিও হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট ইঙ্গিত দিয়েছেন, চুক্তি "অচিরেই হতে পারে", এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও ট্রাম্পের "বড়, ভালো, সুন্দর চুক্তি"র মন্তব্যের জবাবে আশাবাদ জানিয়ে বলেছেন, দিল্লি এ ধরনের চুক্তিকে স্বাগত জানাবে—তবুও দুই দেশের আলোচকরা এখনো কঠিন দর-কষাকষিতে লিপ্ত।

মূল বিরোধের বিষয়
সবচেয়ে বড় জটিলতা তৈরি হয়েছে কৃষি পণ্য, গাড়ির যন্ত্রাংশ, এবং ভারতীয় স্টিলের উপর শুল্ক নিয়ে।

ভারতীয় বাণিজ্য প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটনে তাদের অবস্থান বাড়িয়েছে, নতুন আলোচনার জন্য। দিল্লি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে কৃষি ও দুগ্ধ খাতে তাদের “গভীর লাল দাগ” রয়েছে—অর্থাৎ ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারতের বাজার আরও বেশি উন্মুক্ত হোক।

“পরবর্তী সাত দিন চূড়ান্ত হতে পারে—ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি সীমিত ‘মিনি-চুক্তি’তে পৌঁছাবে, না কি আপাতত আলোচনা বন্ধ হয়ে যাবে,” বলেছেন দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা জিটিআরআই-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক ভারতীয় বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব।

কৃষি—সবচেয়ে বড় অচলাবস্থা
ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের কৃষি বাজারে প্রবেশাধিকার চাইছে। কিন্তু ভারত তা রক্ষা করছে খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের জীবন-জীবিকা এবং রাজনীতিক কারণ দেখিয়ে।

“চুক্তি আটকে থাকার অন্যতম কারণ হলো—যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য ভারতের বাজারে ঢোকানো। ভারতের পক্ষে এটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে খুব সংবেদনশীল ইস্যু,” বলেন রিচার্ড রোসো, যিনি ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এ ভারতের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ করেন।

তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে ভারতের অ-শুল্ক বাধা বা ‘নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার’। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের নতুন ‘কোয়ালিটি কন্ট্রোল অর্ডার’ (QCO), যা যুক্তরাষ্ট্রের মতে অতিরিক্তভাবে আমদানির নিয়ম কঠোর করছে।

ভারত ইতোমধ্যেই ৭০০টির বেশি কোয়ালিটি কন্ট্রোল আদেশ চালু করেছে, যার উদ্দেশ্য—নিম্নমানের পণ্য প্রতিরোধ ও দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া। তবে নীতি আয়োগের সদস্য সুমন বেরি একে বলেছেন “দমনমূলক হস্তক্ষেপ”, যা দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্পের খরচ বাড়াচ্ছে।

খাদ্যনীতি ও ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (MSP)
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৃষিপণ্যের বাণিজ্য এখনও তুলনামূলকভাবে সীমিত—প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। ভারত থেকে রপ্তানি হয় চাল, চিংড়ি ও মসলা; আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে বাদাম, আপেল ও মসুর ডাল। তবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই তালিকায় যুক্ত হোক ভুট্টা, তুলা, সয়াবিন ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুল্ক ছাড় দিলে ভারতের কৃষক রক্ষাকারী ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (MSP) এবং সরকারি ক্রয় নীতিতে চাপ পড়তে পারে।

“দুধ, চাল, গমের মতো পণ্যে কোনও শুল্ক ছাড় আসছে না—এই খাতগুলো খুবই স্পর্শকাতর, যা দেশের ৭০০ মিলিয়ন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্ভর করে,” বলেন অজয় শ্রীবাস্তব।

নজরে এসেছে একটি নীতি আয়োগ পেপার, যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাল, দুগ্ধ, ভুট্টা, আপেল, বাদাম, জিএম সয়াবিনসহ কিছু কৃষিপণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার। তবে এটি এখনো সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান কি না, তা স্পষ্ট নয়।

“যদি যুক্তরাষ্ট্র বলে—ভারত কৃষিপণ্যে ছাড় না দিলে কোনও চুক্তি হবে না, তাহলে তাদের প্রত্যাশা ভুল ছিল। একটি গণতান্ত্রিক সরকার সবসময়ই বাণিজ্যনীতি নির্ধারণে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য,” বলেন রোসো।

‘মিনি-ডিল’ই কি হতে যাচ্ছে সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সীমিত চুক্তিই এখন সবচেয়ে সম্ভাব্য ফলাফল। যেমনটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ৮ মে-তে সম্পন্ন হয়েছে।

এই মিনি-চুক্তিতে ভারত কিছু শিল্পপণ্যে শুল্ক কমাতে পারে—যেমন গাড়ির যন্ত্রাংশ (যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের দাবি)—এবং কিছু কৃষিপণ্যে কোটা বা সীমিত ছাড় দিতে পারে, যেমন: বাদাম, ভুট্টা, আপেল, আঙ্গুর, অলিভ অয়েল, মদ ও ওয়াইন।

তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র চাইবে ভারত বড় অংকের বাণিজ্যিক চুক্তি করুক—যেমন তেল, এলএনজি, বোয়িং এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার, পারমাণবিক চুল্লি ইত্যাদি। এছাড়াও রিটেইল খাতে বিদেশি বিনিয়োগের নিয়ম শিথিল করতেও চাপ থাকতে পারে—যা অ্যামাজন ও ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেবে।

সেবা খাত, ডিজিটাল রেগুলেশন ও আইপি অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা পরবর্তী চুক্তির জন্য রেখে দেওয়া হতে পারে।

শুরুর দিকে মোদি-ট্রাম্প বৈঠকে চুক্তির রূপরেখা ছিল স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্র মূলত পুঁজিনির্ভর শিল্পপণ্যে নজর দেবে, আর ভারত শ্রমনির্ভর পণ্যে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে।

চুক্তি না হলে কী হবে?
চুক্তি ব্যর্থ হলে, ট্রাম্পের পক্ষে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৬% হারে শুল্ক পুনঃপ্রবর্তন করার সম্ভাবনা কম। তবে অধিকাংশ পণ্যে ১০% হারে অতিরিক্ত শুল্ক বসতে পারে, যা MFN (Most Favoured Nation) হারের সঙ্গে যুক্ত হবে।

এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭টি দেশ এই শুল্কের আওতায় ছিল, এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাজ্য তা এড়াতে পেরেছে। ভারতের ওপর আলাদাভাবে এই শুল্ক চাপানো ‘অন্যায়’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে অজয় শ্রীবাস্তব বলেন,
“ট্রাম্পের সঙ্গে কিছুই অসম্ভব নয়—সারপ্রাইজ সবসময়ই সম্ভব।”

Jahan

×