
যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ নিয়ে আইনি লড়াই এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। যদিও সারা দেশে একক বিচারকের রায় দিয়ে আদেশ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত করে দিয়ে শুক্রবার ট্রাম্প প্রশাসন একটি বড় ধরনের আইনি জয় পেয়েছে, তবুও জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
এই রায়ের ফলে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ চ্যালেঞ্জ করে করা মামলাগুলো নিম্ন আদালতে ফিরে গেছে। তবে আদেশটির ভবিষ্যৎ কার্যকারিতা এখনো নিশ্চিত নয়।এখন প্রশ্ন হচ্ছে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বলতে আসলে কী বোঝায়? এবং এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরবর্তী প্রভাব কী হতে পারে?
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বলতে বোঝায় যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলেই সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেশটির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি যদি তার মা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বা সাময়িকভাবে বসবাস করেন তাহলেও।
এই নীতির সূচনা হয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে। তখন ১৪তম সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত করে নিশ্চিত করা হয় যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, এমনকি মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেরাও আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে। সংশোধনীতে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া বা প্রকৃতভাবে নাগরিকত্ব পাওয়া এবং আইনানুগভাবে এখানকার বিচারব্যবস্থার আওতায় থাকা প্রত্যেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।”
প্রায় ৩০ বছর পর ওয়ং কিম আর্ক নামের এক ব্যক্তি, যিনি চীনা অভিবাসী দম্পতির ঘরে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে এলে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। তিনি মামলা করলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, ১৪তম সংশোধনীর আওতায় যেকোনো শিশুই আমেরিকায় জন্ম নিলে নাগরিকত্ব পায়—তার বাবা-মায়ের আইনগত অবস্থান যাই হোক না কেন।
এরপর থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। শুধু কিছু ব্যতিক্রম থাকে যেমন কূটনৈতিক মিশনের অন্তর্ভুক্ত বিদেশি কর্মকর্তার সন্তানদের ক্ষেত্রে।
ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার পক্ষে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত তাঁর নির্বাহী আদেশে বলা হয়—যারা অবৈধ বা অস্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন, তাঁদের সন্তানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।
ট্রাম্পের দাবি, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব “অবৈধ অভিবাসীদের জন্য একটি চুম্বক” হিসেবে কাজ করছে। তিনি ও তাঁর সমর্থকরা ১৪তম সংশোধনীর “subject to the jurisdiction thereof” বাক্যাংশের উপর জোর দেন এবং বলেন, এটি ইঙ্গিত করে যে—অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব দেওয়া সংবিধান অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক ফেডারেল বিচারক এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওয়াশিংটনের এক আদালতে বিচারক জন কাউগেনাওয়ার বলেন, “আমি চার দশকের বেশি সময় ধরে বিচারক হিসেবে কাজ করছি। কিন্তু এর মতো স্পষ্ট সাংবিধানিক লঙ্ঘনের আর কোনো মামলা আমার মনে পড়ে না।”
মারিল্যান্ডে বিচারক ডেবোরা বোর্ডম্যান লিখেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট বহুবার এমন ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দেশের কোনো আদালতই ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেনি।”
সুপ্রিম কোর্ট কী বলেছে?
সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি ট্রাম্পের আদেশের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে কিছু বলেনি। তারা শুধু দেশের কোনো একক ফেডারেল বিচারক যেন জাতীয় পর্যায়ে কোনও আদেশ কার্যকর করতে না পারে, সেই ক্ষমতা সীমিত করেছে। এই সিদ্ধান্তকে ট্রাম্প প্রশাসন একটি “বিচারকদের একক কর্তৃত্বের লাগাম টানা” হিসেবে দেখছে।
লয়োলা ল স্কুলের অধ্যাপক জেসিকা লেভিনসন বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন কৌশলগতভাবে বিচারকের রায় নয়, বরং তাদের দেওয়া জাতীয় স্তরের আদেশের ক্ষমতার বিরুদ্ধেই আপিল করেছে—এবং এ থেকে লাভও হয়েছে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট মূল মামলাটিতে প্রশাসনের পক্ষেই রায় দেবে।”
কী হতে পারে সামনে?
এই রায়ের ফলে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিয়ে করা মামলাগুলো এখন আবার নিম্ন আদালতে যাবে, যেখানে বিচারকদের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী রায় দিতে হবে। আদালত অন্তত ৩০ দিনের জন্য ট্রাম্পের আদেশ স্থগিত রেখেছে, যাতে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করা যায়।
তবে মামলার বাদীপক্ষ এখন “ক্লাস অ্যাকশন” মামলা করে দেশের সব নাগরিকের পক্ষ থেকে একসাথে লড়াই চালাতে পারে। এরই মধ্যে ম্যারিল্যান্ড ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে দুটি নতুন ক্লাস অ্যাকশন মামলা করা হয়েছে।
তবে ওয়াশিংটন অ্যান্ড লি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুজেট মালভো জানান, ক্লাস অ্যাকশন মামলা করা সহজ নয়, কারণ আদালতগুলো এ ধরনের মামলায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এসেছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সোনিয়া সোটোমেয়োর, যিনি বিরোধী মতামত লিখেছেন, নিম্ন আদালতগুলোকে অনুরোধ করেছেন, “যত দ্রুত সম্ভব মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে, যাতে সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিরোধীরা আশঙ্কা করছেন, সারা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত চালু হলে নীতি বিভ্রান্তি, বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
গ্লোবাল রিফিউজ নামের একটি সংস্থার প্রেসিডেন্ট কৃষ ও’মারা ভিগনারাজা বলেন, “জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব শত বছরের প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক অধিকার। নিম্ন আদালতগুলোকে তা সমানভাবে প্রয়োগ করতে না দিলে দেশে বৈষম্য, বিভ্রান্তি ও ভয় ছড়িয়ে পড়বে।”
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস ও সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ট্রাম্প প্রশাসনের বিতর্কিত আদেশ ও সুপ্রিম কোর্টের সীমিত সিদ্ধান্ত একে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এখন অপেক্ষা, নিম্ন আদালত ও চূড়ান্ত রায়ে কী সিদ্ধান্ত আসে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিকত্ব নীতির গতি কোন দিকে মোড় নেয়।
সূত্র:এপি নিউজ
আফরোজা