ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি: কঙ্গো-রোয়ান্ডার তিন দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ২৯ জুন ২০২৫; আপডেট: ০১:৪৮, ২৯ জুন ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি: কঙ্গো-রোয়ান্ডার তিন দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান

দীর্ঘ তিন দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে কঙ্গো ও রোয়ান্ডা একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া এই চুক্তির লক্ষ্য পূর্ব কঙ্গো অঞ্চলে চলমান সহিংসতা বন্ধ করা এবং পাশাপাশি আমেরিকান কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।

চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে কঙ্গো ও রোয়ান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আজকের দিনটি সহিংসতার অবসান ঘটানোর দিন। আমরা এখন আশার, সুযোগের, সমৃদ্ধি ও শান্তির নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছি।”চুক্তিটি ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের 'ট্রিটি রুম'-এ স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি একে “তিন দশকের যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক” বলে মন্তব্য করেন।

তিন দশকের সংঘাতে নিহত লক্ষাধিক, বাস্তুচ্যুত ৭০ লাখ
১৯৯০-এর দশক থেকে কঙ্গোতে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর সংঘাতে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর পেছনে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে রোয়ান্ডার সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠী এম২৩-কে দায়ী করা হয়ে থাকে।
চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন কঙ্গোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসে ওয়াগনার এবং রোয়ান্ডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অলিভিয়ে ন্ডুহুনগিরেহে। দুই পক্ষই আশাবাদী হলেও সতর্ক করেছেন যে, চূড়ান্ত শান্তির পথে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে।

ওয়াগনার বলেন, “অনেক ক্ষত হয়তো সেরে উঠবে, কিন্তু চিরতরে মিলিয়ে যাবে না। যারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন, তারা এখন এই চুক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন। আমরা তাদের আশা ভঙ্গ করতে পারি না।”
চুক্তিকে একটি মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, এতে এম২৩ গোষ্ঠীর সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকায় সংঘাতের সমাপ্তি তৎক্ষণাৎ হবে না।

এম২৩-এর মুখপাত্র অস্কার বালিনদা জানান, তারা এই চুক্তিকে নিজেদের জন্য প্রযোজ্য মনে করছে না। মার্চ মাসে কঙ্গো রিভার অ্যালায়েন্সের নেতা কর্নেইল নাঙ্গা বলেন, “আমাদের না জড়িয়েই আমাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, সেটি আমাদের বিরুদ্ধে যাবে।”

রোয়ান্ডার মন্ত্রী ন্ডুহুনগিরেহে বলেন, কাতারে পৃথক আলোচনা চলছে, যেখানে কঙ্গো ও এম২৩ গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে চেষ্টা করছে। তিনি জানান, রোয়ান্ডা ইতোমধ্যে তাদের ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদিও এতে তাদের সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।

গোপন খনিজের রাজনীতি: যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীন
চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকায় চীনবিরোধী প্রভাব বিস্তারের কৌশলের অংশ বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কঙ্গোর খনিজ সম্পদ বিশেষ করে কোবাল্ট, ট্যানটালাম, ও কল্টানের বিশাল ভাণ্ডারকে ঘিরে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলছে সরাসরি প্রতিযোগিতা।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের হিসাবে, কঙ্গোতে থাকা প্রায় ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ এখনো অপরিষ্কৃত অবস্থায় রয়েছে। এই সম্পদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাই চুক্তির অন্যতম অনুঘটক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চুক্তির শর্তাবলি: অস্ত্র পরিত্যাগ, সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ
চুক্তিতে কঙ্গো ও রোয়ান্ডা একে অপরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা মেনে নেওয়া, সংঘর্ষ বন্ধ, এবং রাষ্ট্র-বহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিরস্ত্রীকরণ ও শর্তসাপেক্ষ পুনঃসমাহিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

চুক্তি লঙ্ঘিত হলে কী হবে, এমন প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করি না কেউ চুক্তি ভাঙবে। তবে যদি কেউ করে, তাহলে আর্থিকসহ অন্যান্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।”

ন্যায়বিচার ছাড়া স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়
ডিপোল নামে কঙ্গোর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিবিদ ক্রিশ্চিয়ান মোলেকা বলেন, “এই চুক্তি একটি বড় অগ্রগতি হলেও এটি সংঘাতের মূল সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবে না।”

তিনি অভিযোগ করেন, “চুক্তির খসড়ায় যুদ্ধাপরাধ বা ভুক্তভোগীদের ন্যায়ের কোনো জায়গা নেই। বরং এটি একধরনের জোরপূর্বক সহাবস্থানের উদ্যোগ, যা দীর্ঘমেয়াদি শান্তি আনতে পারবে না।”

উত্তর কিভু প্রদেশের অধিবাসী ও মানবাধিকারকর্মী হোপ মুহিনুকা বলেন, “আমরা পুরোপুরি আমেরিকানদের ওপর নির্ভর করতে পারি না। আমাদের নিজেদের সুযোগগুলো কাজে লাগানো দরকার।”

রক্তাক্ত ইতিহাসের মূল: ১৯৯৪ সালের রোয়ান্ডা গণহত্যা
এই সহিংসতার ইতিহাস ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ওই সময় হুতু মিলিশিয়ারা ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত তুতসি, মধ্যপন্থী হুতু এবং টোয়া আদিবাসীদের হত্যা করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তুতসি-নেতৃত্বাধীন বাহিনী ক্ষমতায় আসলে প্রায় ২০ লাখ হুতু পালিয়ে যায় কঙ্গোতে।

রোয়ান্ডা বারবার দাবি করে এসেছে, ওই হুতু মিলিশিয়ারাই বর্তমান কঙ্গোর কিছু অংশে সক্রিয় এবং তারা এখনো তুতসি জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি। এ নিয়ে সংঘাত থামেনি বরং বাড়তেই থেকেছে।

কঙ্গো ও রোয়ান্ডার এই শান্তিচুক্তি অনেকের কাছেই নতুন আশার বার্তা। তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন অবিচল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সত্যিকারের ন্যায়ের নিশ্চয়তা, এবং জনগণের আস্থা অর্জন। একমাত্র তখনই আফ্রিকার এই অঞ্চল দীর্ঘস্থায়ী শান্তির স্বাদ পেতে পারে।


সূত্র:এপি নিউজ

আফরোজা

×