ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট আগামী শুক্রবার
ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট আগামী শুক্রবার। এই ভোটের আগে ফের বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশের আলীগড়ে এক নির্বাচনী সমাবেশে মুসলমানদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, কংগ্রেসের নজর আপনার সম্পত্তির ওপর পড়েছে। ক্ষমতায় এলে ওরা মা-বোনদের মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে।
মোদির এই মন্তব্যের পর ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কথা বলে মোদি হিন্দু মহিলাদের মধ্যে মুসলিম তথা কংগ্রেস সম্পর্কে আতঙ্ক তৈরির কৌশল নিয়েছেন। তাদের মতে আলিগড়ের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় এসব কথা বলা তারই প্রমাণ। ওই সমাবেশে মোদি আরও বলেন, আমাদের মা-বোনদের কাছে স্বর্ণ থাকে। যা তাদের কাছে পবিত্র। এখন এদের (কংগ্রেসের) নজর পড়েছে মঙ্গলসূত্রে।
মোদির বক্তব্যের সমর্থনে বিজেপি মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী সত্য কথা বলে কংগ্রেসের নীতি ফাঁস করেছেন। কষ্টার্জিত অর্থ ছিনিয়ে দেওয়ার অধিকার কি কোনো সরকারের থাকে? আর এই কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোটের কাছে তো দেশবাসীর চেয়ে অনুপ্রবেশকারীরা অনেক বেশি আপন। খবর আনন্দবাজার ও হিন্দুস্তান টাইমস অনলাইনের।
সোমবার রাজস্থানে এক সভায় মোদি দাবি করেন, এই নির্বাচনে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির আসন ও ভোটের হার বাড়বে। মোদির এই মন্তব্যের সামান্য পরই ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস জানায়, দক্ষিণ ভারত থেকে কার্যত সাফ হয়ে যাবে বিজেপি। উত্তর ভারতেও দলটির আসন সংখ্যা অর্ধেকে নামবে। কারণ নরেন্দ্র মোদি জনগণের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজস্থানের ওই সমাবেশে মোদি সরাসরি মুসলিমদের নাম উল্লেখ করে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেন।
মোদি বলেন, কংগ্রেস মুসলিমদের মধ্যে দেশের সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে চাইছে। মুসলিমদের সম্পর্কে বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার অভিযোগ তুলে তাদের সরাসরি ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলেন। তার এই মন্তব্যের জবাবে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি বলেন, প্রথম দফার ভোট গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে ঘাবড়ে গেছেন। কারণ দলটি আশানুরূপ ভোট পায়নি। কংগ্রেসের অন্য নেতারা বলেন, এবার বেশি ভোট পাবে না বুঝতে পেরে মোদি এখন মুসলিমদের নাম করে মেরুকরণের চেষ্টায় রয়েছেন।
রুটি-রুজির সমস্যার মতো আসল বিষয় থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা করছেন তিনি। কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, প্রথম দফায় ভোটগ্রহণের ‘গ্রাউন্ড রিপোর্ট’ বলছে, ইন্ডিয়া জোট বিজেপি থেকে এগিয়ে। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রে ইন্ডিয়া জোট সব আসনে জিতছে। বিহার, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশেও বিরোধী জোট এগিয়ে। উত্তরপ্রদেশ-বিহারে ভোট কম পড়েছে। সেটাই বিজেপিরই চিন্তা বাড়িয়েছে। খারাপ ফলের আভাস পেয়ে বিজেপি নেতৃত্ব ভয় পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেও সেটা স্পষ্ট। কংগ্রেসের মতে, বিজেপির প্রার্থীরা নিজেরাই প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন, এবার কোনো ‘মোদি হাওয়া’ নেই। তাই তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তৃতায় তেমন কোনো আশা তৈরি করতে পারেননি। ৪শ’র বেশি আসন জেতার দাবি ও সংবিধান সংশোধনের কথায় উল্টো ফল হয়েছে। জয়রামের দাবি, ‘মোদি সরকারের বিরুদ্ধে চোরা¯্র্েরাত জোরদার হচ্ছে। নতুন হাওয়া তৈরি হচ্ছে।
কংগ্রেসের দাবি, সিএসডিএস সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সিংহভাগ মানুষ চাকরি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। অর্ধেকের বেশি মানুষ মোদি সরকারের ক্ষমতায় ফেরা উচিত কি না, সেই প্রশ্নে ‘না’ বলেছেন। অথবা কোনো জবাব দেননি। কংগ্রেস নেতা সালমান সোজ বলেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী হিন্দু বনাম মুসলমান প্রসঙ্গ তুলে ভোটে জিততে চাইছেন। একজন ক্ষমতালোভী মানুষই এই কাজ করতে পারেন।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বলে প্রধানমন্ত্রীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ওই ভাষণের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও জানানো হয়েছে। এবারের ভোটে কংগ্রেস ও মুসলমানদের সমার্থক করে এভাবে প্রথম সরাসরি আক্রমণাত্মক হন মোদি এবং তা করতে গিয়ে তিনি যে দাবি করেছেন, তা সম্পূর্ণ ভুল বলে অভিযোগ করেছে কংগ্রেস। মোদি বলেন, মুসলমানদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন করার কথা কংগ্রেসের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মনমোহন সিং বলেছিলেন, দেশের সম্পত্তির ওপর মুসলমানদের অধিকার সবার আগে।
জনসভায় আসা মানুষের কাছে মোদি জানতে চান, তারা তাদের কষ্টার্জিত সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে, যাদের অনেক বাচ্চাকাচ্চা হয় তাদের মধ্যে, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বাটোয়ারা হতে দেবেন কি না।
মল্লিকার্জুন খাড়গে আরও বলেন, বোঝা যাচ্ছে, মোদি হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারণ, প্রথম দফায় ‘ইন্ডিয়া’ জোট এগিয়ে গেছে। মোদি তাই ঘৃণা ভাষণের আশ্রয় নিয়েছেন। ক্ষমতার জন্য অসত্য কথা বলছেন। বিরোধীরা যা বলেনি, তা বলে মানুষকে বিপথে চালিত করছেন। আরএসএস ও বিজেপির প্রশিক্ষণই এমন। রাহুল গান্ধি বলেন, এটা হতাশার লক্ষণ। প্রথম দফার ভোট বিরুদ্ধে গেছে বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী এখন মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন।
মিথ্যা ভাষণে তিনি এতটাই নিচে নেমেছেন যে এখন মানুষের নজর ঘোরাতে চাইছেন। রাহুল আরও বলেন, কংগ্রেসের এবারের ইশতেহার বৈপ্লবিক। এবার মানুষ তার পরিবার, কর্মসংস্থান, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভোট দেবে। অন্য ভাবনায় বিচ্যুত হবে না। কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেন, মোদি ¯্র্েরফ একজন ‘মিথ্যুক।’
কড়া প্রতিক্রিয়া জানান, এআইএমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়েইসিও। এক্সে তিনি লিখেন, মোদি মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী বললেন। বহু সন্তানের জন্মদাতা বললেন। ২০০২ সালে থেকে এটাই তিনি করে আসছেন। মুসলমানদের গালি দিচ্ছেন। এটাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি এসব করেন ভোট পাওয়ার জন্য। মোদির আমলেই দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে ৪০ শতাংশ সম্পদ।
সাধারণ হিন্দুদের তিনি মুসলমানদের ভয় দেখাচ্ছেন অথচ তাদের সম্পদ কেড়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ধনী করছেন। মোদির সমালোচনা করেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবও। তিনি বলেন, মোদি যে মিথ্যা বলেন, তা শুধু দেশবাসীই নয়, গোটা পৃথিবী জানে। যেভাবে তিনি কংগ্রেসের ‘ন্যায়পত্র’ ও মনমোহন সিংয়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিলেন, তা নোংরা রাজনীতির উদাহরণ। তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সাকেত গোখলেও সরব। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতার ব্যবহার করুন।’
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের শুরুতে রাম মন্দির নির্মাণ, সরকারি প্রকল্পের সাফল্য, মোদি গ্যারান্টি নিয়ে প্রচারের সুর বেঁধেছিল বিজেপি। নবরাত্রিতে মাংস খাওয়া কিংবা কংগ্রেসের ইস্তেহারে ‘মুসলিম লিগের মনোভাব’ প্রকাশ পাচ্ছে, এ জাতীয় বিক্ষিপ্ত কিছু আক্রমণ ছাড়া সংখ্যালঘু সমাজকে সেভাবে কাঠগড়ায় তুলতে দেখা যায়নি তাদের।
কিন্তু প্রথম দফায় গো-বলয়ে বিশেষ করে এনডিএ শাসিত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং পশ্চিমে মহারাষ্ট্রে দলের পক্ষে ভোট কম পড়ায় নড়েচড়ে বসেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। প্রবল গরম সত্ত্বেও এসব রাজ্যগুলোতে যেভাবে মুসলিম সমাজ ভোট দিতে বেরিয়েছেন, সেই উৎসাহ অনুপস্থিত ছিল হিন্দু সমাজের ভোটারদের মধ্যে। বিজেপি মনে করছে, প্রথম দফায় দলীয় কর্মীদের বড় অংশের মধ্যে ভোট দেওয়ায় প্রবল অনীহা দেখা গিয়েছে। যার একটি কারণ হল আত্মতুষ্টি।
দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব গোড়া থেকেই নির্বাচনের আগেই যুদ্ধে জয় হয়ে গেছে বলে প্রচার চালায়। যা হিতে বিপরীত হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে তৃতীয় দফায় সরকার গড়া হলে কী কাজ করা হবে তার ঢালাও প্রচারে এক শ্রেণির কর্মী মনে করতে শুরু করেন, দল জিতে গিয়েছে। এই লোকসভা নির্বাচনে এবার নজর কাড়ছেন কোটিপতি প্রার্থীরা। দ্বিতীয় দফার ভোটে ৩৯০ জন প্রার্থীই কোটিপতি।
প্রথম দফায় ভোটে ২ হাজার প্রার্থীর মধ্যে অনেকেই শতকোটি রুপির বেশি মালিক ছিলেন। এবার দ্বিতীয় দফার ভোটে প্রায় ৭০০ কোটির সম্পদের মালিকও প্রার্থী রয়েছেন। শুক্রবারের পর পরবর্তী পর্বের ভোট ৭ মে, ১৩ মে, ২০ মে, ২৫ মে এবং সর্বশেষ ১ জুন। ভোট গণনা ৪ জুন।