ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

২০৩০ সালের মধ্যেই পানিশূন্য হতে পারে কাবুল: বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

প্রকাশিত: ০০:৩৮, ৬ জুলাই ২০২৫

২০৩০ সালের মধ্যেই পানিশূন্য হতে পারে কাবুল: বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল, যেখানে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ বসবাস করে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই পানি শেষ হয়ে যেতে পারে—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে দাতব্য সংস্থা ‘মার্সি কর্পস’-এর একটি নতুন প্রতিবেদন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাবুলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনক হারে কমে গেছে।

পানিসঙ্কটের গভীরতা

গত এক দশকে কাবুলের একুইফারের (ভূগর্ভস্থ পানির স্তর) উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ মিটার পর্যন্ত কমে গেছে। প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির প্রাকৃতিক পুনরায় পূরণের তুলনায় প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটার বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এই হারে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই কাবুলের একুইফারগুলো পুরোপুরি শুকিয়ে যেতে পারে এবং প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, কাবুলের অর্ধেকেরও বেশি বোরওয়েল ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কাবুলের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানিতে স্যুয়ারেজ, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেশি।

সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং দ্রুত নগরায়নের ফলে কাবুলের পানিসঙ্কট আজ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০০১ সালে যেখানে শহরের জনসংখ্যা ছিল এক মিলিয়নের কম, এখন তা ছয় মিলিয়নে পৌঁছেছে।

পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও কাবুল পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসেম মায়ার বলেন, “ভূগর্ভস্থ পানির পুনরায় পূরণ ও উত্তোলনের মধ্যে যে ফাঁরাক বাড়ছে, তা গত কয়েক বছর ধরে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কাবুল সত্যিই পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে।”

আফগানিস্তান ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের নেটওয়ার্কের সদস্য নাজিবুল্লাহ সাদিদ বলেন, “আমরা জানি না শেষ কুয়াটি কখন শুকাবে, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত—শেষ প্রায় এসে গেছে।”

পানি উত্তোলনে শ্রেণিগত বৈষম্য

ধনী পরিবারগুলো আরও গভীর বোরওয়েল খুঁড়ে পানি পাচ্ছে, অথচ গরিবরা সেই সুবিধা পাচ্ছে না। ফলে শ্রেণিগত বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। “গরিবরা পানি খুঁজে বেড়াচ্ছে, শিশুদের পড়ালেখার সময় না হয়ে তারা সারাদিন পানি জোগাড়ে ব্যস্ত,” বলছেন পরিবেশ উন্নয়ন সংগঠন EPTDO-র পরিচালক আবদুলহাদি আচাকজাই।

মার্সি কর্পসের তথ্য অনুযায়ী, কেবল কাবুলেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার অনিয়ন্ত্রিত বোরওয়েল রয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আফগানিস্তানে মোট বোরওয়েল আছে প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজারটি।

২০২৩ সালের একটি জাতিসংঘ রিপোর্ট জানায়, কাবুলের প্রায় ৪৯ শতাংশ বোরওয়েল সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে, আর অনেকগুলোই মাত্র ৬০ শতাংশ কার্যক্ষম।

পানিশোষণে বাণিজ্যিক অপচয়

সাদিদের হিসাবে, কাবুলে ৫০০-রও বেশি বেভারেজ ও মিনারেল ওয়াটার কোম্পানি প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছে। কেবল ‘আলোকজয়’ নামক কোম্পানিটিই বছরে প্রায় ১০০ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করে, প্রতিদিন প্রায় ২৫ লাখ লিটার।

এছাড়া কাবুলে ৪০০ হেক্টরেরও বেশি গ্রীনহাউস রয়েছে, যা বছরে ৪ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহার করে সবজি উৎপাদনে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

কাবুলের পানি ভূগর্ভস্থ স্তরে পৌঁছাতে তিনটি প্রধান নদীর উপর নির্ভর করে—কাবুল নদী, পাঘমান নদী ও লোগার নদী। এসব নদী হিন্দুকুশ পর্বতমালার তুষার গলন ও বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশজুড়ে গড় বর্ষণ স্বাভাবিকের মাত্র ৪৫–৬০ শতাংশ হয়েছে।

দশকের পর দশক ধরে যুদ্ধের প্রভাব

বিগত দুই দশকে আফগানিস্তানে নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ অর্থ উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যয় হয়নি। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে পানি সংরক্ষণ ও সরবরাহের প্রকল্পগুলো থমকে গেছে।

আসেম মায়ার বলেন, “এই সংকট বর্তমান প্রশাসনের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। ভালোভাবে পরিচালিত শহরে এই ধরনের প্রভাব ঠেকাতে শক্তিশালী অবকাঠামো ও পানিশাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়, যা কাবুলে নেই।”

বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলো

সাদিদ বলেন, “জার্মান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (KfW) ও ইউরোপীয় সংস্থার সহায়তায় একটি প্রকল্প কাবুলে প্রতিবছর ৪৪ বিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করতে পারত। কিন্তু তালেবান শাসন শুরুর পর সেটি বন্ধ হয়ে গেছে, যদিও এর দুই-তৃতীয়াংশ নির্মাণ শেষ হয়েছিল।”

ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে ২০২১ সালে ‘শাহতূত বাঁধ’ নির্মাণের যে পরিকল্পনা ছিল, তাও বর্তমানে অনিশ্চয়তায়।

কী করা যেতে পারে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির অবকাঠামো উন্নয়নই সংকট সমাধানে প্রথম পদক্ষেপ।

মায়ার বলেন, “কৃত্রিমভাবে ভূগর্ভস্থ পানি পুনরায় পূরণ এবং নতুন পাইপলাইন নির্মাণ জরুরি। এরপর সারা শহরে পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”

আচাকজাই বলেন, “পাহাড়ি নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ, চেক ড্যাম ও জলাধার নির্মাণ—এসবের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ সম্ভব।” তিনি বলেন, “পুরনো পানির পাইপ ও অবকাঠামো সংস্কার করতে হবে।”

কিন্তু এইসব কাজের জন্য যে প্রযুক্তি, অর্থ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার, তা নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় অনুপলব্ধ। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে, খাদ্য সংকট বাড়ছে, এবং মানুষ শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে।

 কাবুল শহর ২০৩০ সালের মধ্যে একটি পানিশূন্য আধুনিক নগরীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-পরবর্তী দুর্বল প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট সংকট এখন কেবল কাবুল নয়, আফগানিস্তানের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। এই সংকট মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন।

Jahan

আরো পড়ুন  

×