ফিলিপাইন নারীরা
ভ্যাটিকানের বাইরে ফিলিপাইনই একমাত্র জায়গা, যেখানে বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ। আর আদালতেও বিষয়টির সুরাহা হতে কয়েক বছর সময় লাগে।
তিন সন্তানের মা ফিলিপাইনের স্টেলা সিবোঙ্গা বিবাহবিচ্ছেদ করতে চান। কিন্তু ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের আইনের কারণে তিনি তা পারছেন না। এই দেশে বিবাহবিচ্ছেদ অবৈধ।
বিবাহবিচ্ছেদপন্থী আইনজীবীদের যুক্তি, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দম্পতিদের সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং পুনরায় বিয়ে করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সহিংস সম্পর্কে বাঁচাও তাঁদের জন্য অনেক কঠিন।
দেশটিতে এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া খুব ধীর ও ব্যয়বহুল। দরিদ্র এই দেশে এমন মামলার জন্য ১০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি ব্যয় হতে পারে। তবে এতেও যে সফলতা আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ কারণে কিছু মানুষ দ্রুত ফলাফলের জন্য অনলাইন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
ম্যানিলার বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী স্টেলা সিবোঙ্গা ১১ বছর ধরে বিবাহবিচ্ছেদের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝি না, কেন এটি এত কঠিন হতে হবে।’ স্টেলার আইনি লড়াইটা শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে ‘মানসিক অক্ষমতার’ অভিযোগ তুলে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আদালতে আবেদন করেন।
৫ বছর ধরে ৩ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার আইনি ফি দেওয়ার পর একজন বিচারক তাঁর পক্ষে রায় দেন। এতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন স্টেলা। কিন্তু সেই স্বস্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ, দেশটিতে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার আইনি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সলিসিটর জেনারেলের অফিস ২০১৯ সালে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই আপিলের বিচারকাজ এখনো ঝুলে আছে।
স্টেলা বলেন, পরে তিনি ওই রায় প্রত্যাহার করার জন্য আপিল আদালতে আবেদন করেন। এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি আদালত। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাঁরা কষ্ট পাচ্ছি, অপব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছি, কেন আবার আইন দ্বারাও শাস্তি পাচ্ছি? আমরা মুক্ত হতে চাই।’
ফিলিপাইনে বিবাহবিচ্ছেদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হলো ক্যাথলিক চার্চ। এই প্রতিষ্ঠান গর্ভপাত ও গর্ভনিরোধকের বিরুদ্ধেও সোচ্চার।
সরকারি আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ১১ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৭৮ শতাংশই ক্যাথলিক। এ কারণে অনেক রাজনীতিক সংবেদনশীল সামাজিক বিষয়ে চার্চের বিরোধিতা করা থেকে সতর্ক থাকেন।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ব্যাপারে কংগ্রেস উল্লেখযোগ্য জয় পেয়েছে। চার্চের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০১২ সালে একটি বিতর্কিত জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন পাস করা হয়। ২০১৮ সালে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ও বিরোধী দলগুলো বিবাহবিচ্ছেদ বিল অনুমোদন করেছিল, যা পরে সিনেটে স্থগিত হয়ে যায়। এ রকম প্রস্তাব এত দূর পর্যন্ত গড়ানোর এটাই প্রথম ঘটনা।
জরিপকারী সংস্থা সোশ্যাল ওয়েদার স্টেশন পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিবাহবিচ্ছেদের প্রতি ফিলিপাইনের নাগরিকদের মনোভাবের পরিবর্তন হচ্ছে। ২০০৫ সালে ৪৩ শতাংশ নাগরিক, যাঁরা একসঙ্গে থাকতে চান না, তাঁরা বিবাহবিচ্ছেদের বৈধতা সমর্থন করেছিলেন। আর ৪৫ শতাংশ নাগরিক ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। ২০১৭ সালে একই সমীক্ষায় ৫৩ শতাংশ সমর্থন দেখিয়েছেন, আর মাত্র ৩২ শতাংশ ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন।
নির্বাচিত হওয়ার আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস বলেছিলেন, দেশে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, বিষয়টি খুব সহজ হওয়াও উচিত নয়।
তবে ফিলিপাইনের ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্সের ফাদার জেরোম সেসিলানো বলেন, ‘বিবাহের ঐতিহ্যগত ধারণাকে ধরে রাখার’ জন্য ভ্যাটিকানের বাইরে একমাত্র দেশ হিসেবে এই জাতির ‘গর্বিত’ হওয়া উচিত। ফাদার বলেন, একটি সম্পর্কের মধ্যে সব সময় অপূর্ণতা থাকবে। তিনি আরও বলেন, একজন নিপীড়নকারী সঙ্গীকে তালাক দেওয়া ‘সহিংসতাকে স্থায়ী করবে’। কারণ, অপরাধী তাদের পরবর্তী সঙ্গীকেও নিপীড়ন করবে।
স্টেলা সিবোঙ্গা নিজেই একজন ক্যাথলিক। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ উঠতে পারে, এই ভয়ে তিনি চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
স্টেলা দীর্ঘদিন ধরে প্রেম করেন। কিন্তু প্রথম বিয়ের আইনি বিচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত ওই প্রেমিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারছেন না তিনি। ফিলিপাইনে ছোটখাটো কোনো ঘটনার বিচারকাজ করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। সেখানে স্টেলার বিবাহবিচ্ছেদের মামলার বিচার শেষ হতে এত দিন যে লাগবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
স্টেলা বলেন, ‘আমি এখনো কৌশলগতভাবে বিবাহিত। এ কারণে মানুষ ভাবেন, আমি একজন পাপী। তাঁরা বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তা যাঁদের একত্র করেছেন, তাঁদের আলাদা করা যায় না। সত্যিই? এমনকি যদি আপনার স্বামী আপনাকে হত্যার চেষ্টাও করে, তারপরও বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয় না?’
স্টেলা আরও বলেন, স্বামীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একদম ভালো নয়। তাঁকে দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করতে বাধ্য করেছিলেন স্বামী। নিজের বিবাহবিচ্ছেদের আগে স্টেলা চান না তাঁর সন্তানদের বিয়ে হোক। তিনি বলেন, ‘আমি সন্তানদের বলেছি, তারা বিয়ে ছাড়াই চাইলে যত খুশি সন্তান নিতে পারে। কিন্তু আমি কখনোই তাদের বিয়ের ব্যাপারে রাজি হব না। আমি চাই না, তাদের জীবন আমার মতো শেষ হয়ে যাক।’
সূত্র:এএফপি
টিএস