
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আলোচিত এক চুক্তির ঘোষণা দেওয়ার পরও দুপক্ষের বিরোধ আরও ঘনীভূত হয়েছে। বরং, ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টির ওপর চাপ প্রয়োগের সবধরনের কৌশল ব্যবহার করছে, যা এরই মধ্যে একাধিক বিতর্ক ও আইনি লড়াইয়ের জন্ম দিয়েছে।
সাম্প্রতিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হার্ভার্ডের স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে অভিযোগ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টি ফেডারেল বৈষম্যবিরোধী আইন লঙ্ঘন করেছে। একইসঙ্গে অভিবাসন বিষয়ক কর্তৃপক্ষ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ থেকে হার্ভার্ডের বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য চেয়ে সাবপোনা (আইনি সমন) জারি করা হয়েছে।
আমেরিকান কাউন্সিল অন এডুকেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জোনাথন ফ্যানস্মিথ বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা অনুসরণ করছে যার মাধ্যমে তারা সমস্ত সম্ভাব্য প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের শর্ত মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “জনমত থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত প্রায় সবক্ষেত্রে তারা এই লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে, তারপরও বারবার বিষয়গুলো রাজনীতিকরণ করছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকমাহন হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইহুদি-বিদ্বেষী হয়রানি ও বৈষম্য চলমান থাকায় এটি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও মার্কিন করদাতাদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রত্যাশা করে যে নিউ ইংল্যান্ড কমিশন অব হায়ার এডুকেশন এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”
হার্ভার্ডের স্বীকৃতি বাতিল করা হলে ফেডারেল শিক্ষাঋণের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। সাধারণত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি বাতিল হলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়, যদিও হার্ভার্ডের মতো প্রাচীন ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এর আগে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ হার্ভার্ডের বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য জানতে চেয়ে সাবপোনা জারি করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন কঠোরীকরণ নীতির অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যেই সব বৈধ অনুরোধ অনুযায়ী তথ্য দিয়েছে এবং কোনো তথ্য গোপন করেনি।
অ্যালবানি ল’ স্কুলের অধ্যাপক রে ব্রেসিয়া বলেন, “হার্ভার্ডের পূর্ণ অধিকার রয়েছে এই সাবপোনাকে চ্যালেঞ্জ করার যদি সেটি অপ্রাসঙ্গিক বা অধিকতর বিস্তৃত হয়ে পড়ে, কিংবা শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘন করে।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে জানায়, তারা ১৯২৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে স্বীকৃতি বজায় রেখেছে এবং আইন অনুযায়ী সব প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করেছে।
এক বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মুখপাত্র বলেন, “এই ইস্যুতে হার্ভার্ড নিরপেক্ষ নয় এবং সরকারের অভিযোগের সঙ্গে জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করে। হার্ভার্ড এখনও নিউ ইংল্যান্ড কমিশনের স্বীকৃতি মানদণ্ড পূরণ করে যাচ্ছে।”
হার্ভার্ডের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের চলমান চাপ অনেকের কাছেই একটি বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত, ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়া ও ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনের চাপে নানা ছাড় দিয়েছে বলে জানা গেছে।
রাটগার্স ইউনিভার্সিটির ‘সেন্টার ফর মাইনরিটি সার্ভিং ইনস্টিটিউশনস’-এর নির্বাহী পরিচালক মেরিবেথ গ্যাসম্যান বলেন, “হার্ভার্ড আইনি পথে এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে। এবং তারা এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছে।”
বিরোধের এই উত্তাপের মধ্যেই গত জুনে ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, হার্ভার্ডের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য চুক্তি ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে’ রয়েছে।২০ জুন ট্রাম্প বলেন, “আমরা হার্ভার্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি এবং আগামী সপ্তাহ বা তারও আগে একটি চুক্তি ঘোষণা করা হতে পারে। তারা খুবই শালীনভাবে আলোচনায় অংশ নিয়েছে এবং যেটি সঠিক, সেটাই করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে হয়েছে।”
তিনি আরও লেখেন, “যদি আলোচনার ভিত্তিতে চুক্তি হয়, এটি হবে বিস্ময়করভাবে ঐতিহাসিক এবং আমাদের দেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।”
তবে সেই ঘোষণার পর থেকে সরকার পক্ষ থেকে আর কোনো আপডেট আসেনি। হার্ভার্ডও সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে মুখ খোলেনি।
ফ্যানস্মিথ বলেন, “এটি নিয়ে এত কথা বলার পরও যদি কোনো চুক্তির বাস্তব রূপ না হয়, তাহলে মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে। হার্ভার্ড বহু আগেই স্পষ্ট করেছে, তারা তাদের শিক্ষকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে না।”
তিনি আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত কয়েকবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা চুক্তির দ্বারপ্রান্তে, অথচ বাস্তবে কিছুই হয়নি। তাই এই ইস্যুতে এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা একেবারে যুক্তিযুক্ত।”
একদিকে হার্ভার্ডকে ঘিরে আইন-রাজনীতি-আবেগ ও কর্তৃত্বের চরম সংঘাত চলছে, অন্যদিকে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, একাডেমিক স্বাধীনতা এবং অভিবাসন নীতি ঘিরে গড়ে উঠছে নতুন বিতর্ক। এই সংঘাত শুধু হার্ভার্ডকে নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকার আরও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
সূত্র:The Hill
আফরোজা