ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২

তেল মশলা ছাড়া খাবার কি সত্যিই হার্ট-ফ্রেন্ডলি?

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৯ আগস্ট ২০২৫

তেল মশলা ছাড়া খাবার কি সত্যিই হার্ট-ফ্রেন্ডলি?

ছ‌বি: প্রতীকী

তেল মশলা ছাড়া খাবার খাওয়া নিয়ে এখন অনেকের মধ্যে কৌতূহল রয়েছে। বিশেষ করে যারা হৃদরোগ নিয়ে সচেতন, তারা প্রায়ই ভাবেন—তেল বা মশলা একেবারেই বাদ দিলে কি হৃদপিণ্ড সুস্থ থাকে? বিষয়টি বোঝার জন্য আগে আমাদের জানতে হবে তেল ও মশলার প্রভাব এবং শরীরের প্রকৃত চাহিদা। তেল মানে সবসময় ক্ষতিকর কিছু নয়। আমাদের শরীরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে ভালো ফ্যাট বা চর্বি প্রয়োজন। উদ্ভিজ্জ তেল যেমন অলিভ অয়েল, সূর্যমুখীর তেল বা সরিষার তেল শরীরে ভালো কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। আবার অতিরিক্ত তেল, বিশেষ করে ভাজা-পোড়া খাবারের মাধ্যমে ট্রান্স ফ্যাট ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে যায় এবং ধীরে ধীরে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। তাই তেল পুরোপুরি বাদ দেওয়ার চেয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং সঠিক উৎস থেকে তেল খাওয়াই আসল সমাধান।

মশলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমরা যেসব মশলা রান্নায় ব্যবহার করি, যেমন হলুদ, আদা, রসুন, দারুচিনি বা গোলমরিচ—এগুলো আসলে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। হলুদের কারকিউমিন প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, রসুন রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, আদা হজমে ভালো প্রভাব ফেলে। আবার অতিরিক্ত ঝাল মরিচ বা অতিরিক্ত নোনতা মশলা শরীরে ক্ষতি করতে পারে, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায়। অর্থাৎ মশলাও পুরোপুরি বাদ দেওয়ার বিষয় নয়, বরং সঠিক পরিমাণ ও প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করাই স্বাস্থ্যকর।

যখন আমরা একেবারে তেল ও মশলা ছাড়া খাবার খাই, তখন রান্নার স্বাদ অনেকটাই কমে যায় এবং দীর্ঘদিন ধরে এমন খাবার খাওয়া অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে। খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে গেলে পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণে অনীহা তৈরি হয়। এর ফলে শরীরে প্রয়োজনীয় ক্যালোরি ও পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আবার একেবারে তেল বাদ দিলে শরীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন যেমন ভিটামিন এ, ডি, ই ও কে সঠিকভাবে শোষণ করতে পারে না, কারণ এগুলো ফ্যাট-সলিউবল ভিটামিন। তাই চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ করে পুরোপুরি তেল বাদ দিয়ে খাওয়া দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যকর নাও হতে পারে।

হার্ট-ফ্রেন্ডলি খাবারের মূল ধারণা হলো হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর উপাদান কমানো এবং উপকারী উপাদান বাড়ানো। অর্থাৎ অতিরিক্ত লবণ, চিনি, ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট কমিয়ে তাজা শাকসবজি, ফলমূল, পূর্ণ শস্য, ডাল, মাছ, বাদাম ইত্যাদির পরিমাণ বাড়ানো। তেল ও মশলার ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য—অতিরিক্ত নয়, বরং পরিমিত। যেমন, প্রতিদিন খাবারে ২-৩ চামচ ভালো মানের উদ্ভিজ্জ তেল ব্যবহার করলে হার্টের কোনো ক্ষতি হয় না বরং প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। একইভাবে রান্নায় সামান্য হলুদ, আদা, রসুন, গোলমরিচ ব্যবহার করলে শুধু স্বাদই বাড়ে না, বরং স্বাস্থ্যগত উপকারও পাওয়া যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্যাভ্যাসে (Mediterranean diet) পরিমিত অলিভ অয়েল, বাদাম, তাজা শাকসবজি, মাছ ও পূর্ণ শস্য থাকে এবং এ ধরনের খাবার নিয়মিত খেলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কমে। সেখানে তেল বা মশলা একেবারে বাদ দেওয়া হয় না, বরং স্বাস্থ্যকর উৎস থেকে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে খাওয়া হয়। অন্যদিকে, অতিরিক্ত ভাজা-পোড়া, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও লবণ বেশি মেশানো রান্না হার্টের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

তেল-মশলা ছাড়া খাবার স্বল্প সময়ের জন্য ডায়েট বা ডিটক্সের অংশ হতে পারে, বিশেষ করে যদি কারও হজম সমস্যা বা পেটের অসুবিধা থাকে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ হার্টের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, মানসিক চাপ কমানো ও ধূমপান-মদ্যপান থেকে দূরে থাকা। তেল ও মশলাকে শত্রু না ভেবে, বরং সঠিকভাবে বন্ধুত্ব করা শিখতে হবে। কারণ হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখার জন্য শুধু খাবারের ধরন নয়, বরং পুরো জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তেল মশলা ছাড়া খাবার একদমই হার্ট-ফ্রেন্ডলি— এমন বলা ভুল হবে। তেলের ধরন, মশলার প্রকার, পরিমাণ ও রান্নার পদ্ধতি আসল বিষয়। স্বাস্থ্যকর তেল ও উপকারী মশলা পরিমিতভাবে ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ যেমন বজায় থাকে, তেমনি হৃদপিণ্ডও সুস্থ থাকে। তাই চরম পরিহারের বদলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নির্বাচনই হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী হার্ট-ফ্রেন্ডলি জীবনযাপনের মূল চাবিকাঠি।

এম.কে.

×