ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২

রাগ কমাতে পারলে হার্ট বাঁচবে, বিজ্ঞান কী বলে?

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ আগস্ট ২০২৫

রাগ কমাতে পারলে হার্ট বাঁচবে, বিজ্ঞান কী বলে?

ছ‌বি: প্রতীকী

রাগ এমন একটি অনুভূতি যা আমরা সবাই কম-বেশি অনুভব করি। কখনও কখনও রাগ আমাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, কারণ এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বা নিজের সীমানা রক্ষা করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বা দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের মনে জমে থাকে, তখন তা শরীরের জন্য, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। বিজ্ঞানীরা বারবার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে অতিরিক্ত রাগ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় এবং হৃদয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।

রাগের সময় আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। মস্তিষ্ক তখন অ্যাড্রেনালিন এবং কর্টিসল নামের হরমোন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এই হরমোনগুলো আমাদের শরীরকে ‘লড়াই বা পালানোর’ অবস্থায় নিয়ে যায়, যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ হঠাৎ বৃদ্ধি পায় এবং রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়। এই পরিস্থিতি যদি বারবার ঘটে, তাহলে হৃদপিণ্ডের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

গবেষণা বলছে, যারা সহজে রাগে ফেটে পড়েন বা ক্ষুদ্র বিষয়ের জন্য তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান, তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাগের বিস্ফোরণের পরবর্তী দুই ঘণ্টায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কারণ, রাগের সময় রক্তের ঘনত্ব সাময়িকভাবে বেড়ে যায়, যা রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা সৃষ্টি করে এবং হার্টে রক্তপ্রবাহ বন্ধ করতে পারে।

শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়, দীর্ঘস্থায়ী রাগ মানসিক চাপকে বাড়িয়ে তোলে, যা ঘুমের ব্যাঘাত, অস্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস এবং শারীরিক অনিয়মের দিকে ঠেলে দেয়। এসব মিলিয়ে হার্টের স্বাস্থ্যের ওপর একটি ধীরে ধীরে ক্ষয়কারী প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে এই চাপ রক্তনালীগুলোতে প্রদাহ তৈরি করে, যা হৃদরোগের জন্য বড় একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত।

অন্যদিকে, যেসব মানুষ রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন, তারা তুলনামূলকভাবে সুস্থ হৃদয়ের অধিকারী হন। কারণ, রাগ নিয়ন্ত্রণ মানে শরীরে হঠাৎ করে হরমোনাল বিস্ফোরণ কম হওয়া, রক্তচাপ স্থিতিশীল থাকা এবং হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ না পড়া। মন শান্ত থাকলে শরীরও শান্তভাবে কাজ করে, ফলে হার্টের সুস্থতা বজায় থাকে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাগ কমানোর জন্য কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। যেমন, রাগের মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ড গভীর শ্বাস নেওয়া, সেই পরিস্থিতি থেকে সাময়িকভাবে সরে যাওয়া, বা কোনো বিশ্বস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলা। নিয়মিত ব্যায়ামও রাগ কমাতে এবং হৃদয়কে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে, কারণ ব্যায়াম শরীরের চাপ কমায় এবং মেজাজ ভালো করে। ধ্যান বা মেডিটেশন মনকে শান্ত রাখতে কার্যকর, যা সরাসরি হৃদযন্ত্রের উপকারে আসে।

রাগ কমানোর আরেকটি উপকার হলো সামাজিক সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন। যখন আমরা সহজে রাগ করি না, তখন পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কও সুন্দর থাকে। সম্পর্ক ভালো থাকলে মানসিক চাপও কম থাকে, যা আবার হার্টের জন্য উপকারী। এভাবে একে অপরের সঙ্গে সুস্থ যোগাযোগ বজায় রাখা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য এক ধরনের প্রাকৃতিক সুরক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।

বিজ্ঞান স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে রাগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, বরং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি। বিশেষ করে হৃদপিণ্ডের মতো সংবেদনশীল অঙ্গকে রক্ষা করার জন্য রাগ কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হৃদয় প্রতিদিন নিরলসভাবে রক্ত পাম্প করে পুরো শরীরে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। যদি আমরা রাগের মতো নেতিবাচক আবেগ দিয়ে সেটিকে অতিরিক্ত চাপে ফেলি, তাহলে সেটি দীর্ঘদিন সুস্থভাবে কাজ করতে পারবে না।

তাই জীবনযাপনে রাগ কমানোর অনুশীলন শুরু করা দরকার। এটি কেবল আমাদের মনকে শান্ত রাখবে না, বরং আমাদের হার্টকেও দীর্ঘদিন সুস্থ ও কার্যক্ষম রাখবে। মনে রাখা উচিত, শান্ত মন মানেই শান্ত হৃদয়, আর শান্ত হৃদয় মানেই সুস্থ জীবন। রাগ কমাতে পারলে সত্যিই হার্টকে বাঁচানো সম্ভব—এ কথা বিজ্ঞানও জোর দিয়ে বলছে।

এম.কে.

×