
ছবি: সংগৃহীত।
কোলন বা বৃহদান্ত্রের ক্যানসার বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য ক্যানসারগুলোর একটি। সঠিক জীবনযাপন, যেমন নিয়মিত স্ক্রিনিং ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস-এগুলো ক্যানসার প্রতিরোধে পরিচিত পন্থা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এক নতুন সম্ভাবনার নাম: ম্যাগনেশিয়াম। শাকসবজি ও বাদামের মতো সহজলভ্য খাবারে পাওয়া এই খনিজ পদার্থ কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ম্যাগনেশিয়াম কীভাবে কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক?
ম্যাগনেশিয়াম শরীরের ৩০০-র বেশি এনজাইম সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি পেশি ও স্নায়ুর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ম্যাগনেশিয়াম কোষের বৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে-যা ক্যানসার প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একটি ২০১২ সালের মেটা-অ্যানালাইসিস (American Journal of Clinical Nutrition) অনুযায়ী, প্রতিদিন ১০০ মিলিগ্রাম করে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণে কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি ১২% পর্যন্ত কমে যায়।
২০০৫ সালে JAMA-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৭৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে যারা বেশি পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করতেন, তাদের কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
২০২২ সালের Biological Trace Element Research-এর গবেষণায় দেখা যায়, ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োগে পরীক্ষাগারে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি কমে এবং কিছু ক্ষেত্রে কোষ মৃত্যু (cell death) ঘটে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও ম্যাগনেশিয়াম ক্যানসার পুরোপুরি প্রতিরোধ বা নিরাময় করতে পারে না, তবে এটি অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিকে ধীর বা বন্ধ করতে সহায়তা করে, যা ক্যানসার রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাগনেশিয়াম কীভাবে কাজ করে?
গবেষণায় বলা হয়েছে, ম্যাগনেশিয়াম নিচের কয়েকটি প্রক্রিয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে:
ডিএনএ মেরামত ও প্রতিলিপি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যা কোষের সঠিক বিভাজন নিশ্চিত করে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ কমায়, যা ক্যানসার বিকাশের অন্যতম কারণ।
অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিকে দমন করে, এবং কিছু ক্ষেত্রে টিউমার কোষ ধ্বংস করে।
অর্থাৎ, ম্যাগনেশিয়াম শরীরে কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনে।
কীভাবে প্রাকৃতিকভাবে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ বাড়ানো যায়?
সুখবর হলো, প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমেই সহজেই পর্যাপ্ত ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করা যায়। নিচে এমন কিছু খাদ্য উপাদানের তালিকা দেওয়া হলো যা ম্যাগনেশিয়ামে সমৃদ্ধ:
১. পাতাযুক্ত সবজি
পালং শাক, কেল, ও সুইস চার্ড-এই ধরনের গাঢ় সবুজ শাকসবজি ম্যাগনেশিয়ামের দারুণ উৎস। এক কাপ রান্না করা পালং শাকে থাকে প্রায় ১৬০ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম, যা নারীদের দৈনিক চাহিদার অর্ধেক।
২. বাদাম ও বীজ
বাদাম (বিশেষ করে আমন্ড), কুমড়ার বীজ, সূর্যমুখী বীজ, ও চিয়া বীজ ম্যাগনেশিয়ামে ভরপুর। যেমন, ১ আউন্স আমন্ডে প্রায় ৮০ মি.গ্রা., আর ২ টেবিল চামচ চিয়া বীজে ১০০+ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
৩. ডাল ও শিমজাতীয় খাবার
কালো মসুর, ছোলা, সয়াবিন ও কিডনি বিনে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম। এক কাপ রান্না করা কালো শিমে থাকে ১২০ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম।
৪. পূর্ণ শস্য
সাদা চাল বা পরিশোধিত শস্য বাদ দিয়ে ব্রাউন রাইস, ওটস, কুইনোয়া ও হোল হুইট ব্রেড গ্রহণে ম্যাগনেশিয়াম অনেক বেশি পাওয়া যায়। এক কাপ রান্না করা কুইনোয়ায় প্রায় ১১০ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
৫. লো-ফ্যাট ডেইরি
যদিও দুধকে ম্যাগনেশিয়ামের প্রধান উৎস হিসেবে ধরা হয় না, এক কাপ লো-ফ্যাট দুধে ২৪–২৭ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম থাকে।
৬. ফ্যাটি মাছ
স্যালমন, ম্যাকারেল ও হ্যালিবাট প্রজাতির মাছেও মাঝারি পরিমাণ ম্যাগনেশিয়াম থাকে। ৩ আউন্স রান্না করা স্যালমনে থাকে ২৫–৩০ মি.গ্রা. ম্যাগনেশিয়াম।
কতটা ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজন?
নারীদের জন্য দৈনিক ম্যাগনেশিয়াম চাহিদা ৩১০–৩২০ মিলিগ্রাম এবং পুরুষদের জন্য ৪০০–৪২০ মিলিগ্রাম। শাকসবজি, বাদাম, শস্য ও মাছসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে সহজেই এই চাহিদা পূরণ সম্ভব।
যদিও কোনো একক পুষ্টি উপাদান ক্যানসার পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারে না, তবে ম্যাগনেশিয়ামের মতো খনিজ উপাদান দেহে কোষের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করে, প্রদাহ কমায় এবং ডিএনএ সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে-যা ক্যানসার প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখে।
তাই স্বাস্থ্য সচেতনদের জন্য প্রাকৃতিকভাবে ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ বাড়ানো হতে পারে এক সহজ ও কার্যকর পদক্ষেপ-একটি সুস্থ ও ক্যানসারমুক্ত ভবিষ্যতের পথে।
সূত্র: দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া।
মিরাজ খান