
ছবি: প্রতীকী
ঘুম মানুষের শরীর ও মনকে আরাম দেয়, ক্লান্তি দূর করে এবং পরবর্তী দিনের জন্য শক্তি জোগায়। কিন্তু অনেক সময় এই ঘুমের মধ্যেই ঘটে যেতে পারে ভয়ানক ঘটনা— যেমন হার্ট অ্যাটাক। অনেকেই ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা হঠাৎ মৃত্যুজনিত সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রশ্ন হলো, ঘুমের মধ্যে কেন এবং কখন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে?
রাতের বেলা শরীরের স্বাভাবিক কার্যপ্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন ঘটে। ঘুমের সময় হৃৎপিণ্ডের গতি কমে আসে, রক্তচাপ কমে যায় এবং শরীর একটু শান্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু কিছু বিশেষ পরিস্থিতি বা স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকলে এই সময়টাই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে।
প্রথমত, উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার। অনেক মানুষ দিনের বেলায় ওষুধ খেয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন, কিন্তু রাতে ঘুমের সময় ওষুধের প্রভাব কমে গেলে রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে হৃৎপিণ্ডে চাপ পড়ে এবং এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে যারা নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করেন না কিংবা ওষুধ ঠিকমতো খান না, তাদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি।
দ্বিতীয়ত, ডায়বেটিস বা শর্করার রোগ। ডায়বেটিসে হৃদরোগের সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে রক্তনালির ভেতরের প্রলেপ নষ্ট হয়, ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় ঘুমের মধ্যে যদি শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়, তাহলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
তৃতীয়ত, ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট বা স্লিপ অ্যাপনিয়া নামক রোগ। অনেকেই গভীর ঘুমে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য, আবার হঠাৎ করে শ্বাস নেয়। এই সমস্যা বারবার ঘটলে শরীরের অক্সিজেন কমে যায় এবং এতে হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন পৌঁছায় না, যা হার্ট অ্যাটাকের একটি বড় কারণ হতে পারে। অনেক মানুষ বুঝতেই পারেন না যে তারা রাতে এই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন।
চতুর্থত, অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান। এই দুটি অভ্যাসই হৃৎপিণ্ডের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ধূমপানে রক্তনালি সঙ্কুচিত হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। মদ্যপান হৃৎপিণ্ডের ছন্দে গোলমাল তৈরি করে। রাতে যখন শরীর বিশ্রামে থাকে, তখন এইসব পদার্থের নেতিবাচক প্রভাব আরও বেশি করে হৃৎপিণ্ডে পড়ে।
পঞ্চমত, অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। সারাদিনের মানসিক চাপ অনেক সময় রাতে ঘুমের সময়ও শরীর থেকে যায় না। কেউ কেউ দুঃস্বপ্নে ভোগেন, কেউ কেউ গভীরভাবে চিন্তা করেন, যার ফলে শরীরের অ্যাড্রিনালিন হরমোন বেড়ে যায় এবং হৃৎপিণ্ডে চাপ পড়ে। এর ফলে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
ষষ্ঠত, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। যেমন- অনিয়মিত খাওয়া, ফাস্ট ফুড, ব্যায়ামের অভাব ইত্যাদি। শরীর ফিট না থাকলে হৃৎপিণ্ডও দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি, যাদের শরীরে কোলেস্টেরল বা ফ্যাটের পরিমাণ বেশি, তাদের রক্তনালিতে চর্বি জমে যায়, যেটা ঘুমের সময় রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
সপ্তমত, রাতে দেরিতে খাওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া। রাতে বেশি খেয়ে বা ভারী খাবার খেয়ে ঘুমালে হজমে সমস্যা হয়, গ্যাস তৈরি হয় এবং বুক ভারী লাগে। এই ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা হার্টে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
সবশেষে বয়স ও জিনগত কারণও গুরুত্বপূর্ণ। যাদের পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস আছে, তাদের ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে ৪০-এর বেশি বয়সী পুরুষ এবং ৫০-এর বেশি বয়সী নারীদের এই সময়টা থেকে বেশি সতর্ক থাকা দরকার।
এইসব বিষয় মাথায় রেখে বলা যায়, ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা তখনই বাড়ে, যখন আমরা আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ ও শারীরিক অবস্থার দিকে মনোযোগ দিই না। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, ব্লাড প্রেসার ও সুগার চেক করা, নিয়ম করে হাঁটা-চলা করা এবং ধূমপান-মদ্যপান বর্জন করলেই এই বিপদ অনেকটা কমিয়ে আনা যায়। ঘুম যেন শান্তি এনে দেয়, তা নিশ্চিত করতেই প্রয়োজন সচেতন জীবনযাপন।
এম.কে.