
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শহীদ আজিজ হলে প্রতিনিধি নির্বাচনকে ঘিরে হুমকি, র্যাগিং ও দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক পক্ষের অভিযোগ এবং নিরাপত্তা বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন ও হল প্রশাসন নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার (২৩ জুলাই) রাতে শহীদ আজিজ হলে কয়েকজন প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, ৪৯তম ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী ৫০তম ব্যাচের কয়েকজন প্রার্থীকে বিটাক মোড়ে ডেকে নেন এবং কথোপকথনের এক পর্যায়ে নির্দিষ্ট একজন প্রার্থীকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আহ্বান করেন।
পরবর্তীতে ওই রাতেই ৫০তম ব্যাচের একজন প্রার্থীকে হলের এক্সটেনশনে ডেকে র্যাগিং করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাকে ‘ফরমাল ড্রেস’ পরে আসতে বলা হয় এবং সেখানে তার নির্বাচনী যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অবমাননাকর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে রয়েছে, ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মুশফিক আহমেদ নাবিল, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজম্যান্ট বিভাগের মোসাইদুল ইসলাম তনিম, অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জিসান। যার মধ্যে মুশফিক আহমেদ নাবিল হল প্রতিনিধি নির্বাচনের একজন প্রার্থী ছিলো। যাদের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে।
ঘটনার জেরে ৫০তম ব্যাচ এবং পরবর্তীতে ৪৮তম ব্যাচও একযোগে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে এ ঘটনায় শুধুমাত্র ব্যাচভিত্তিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং এলাকাভিত্তিক প্রভাব ও সুসংগঠিত গোষ্ঠী রাজনীতির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে আলোচিত একটি এলাকাভিত্তিক গোষ্ঠী (মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও আশেপাশের জেলা থেকে আগত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত) শহীদ আজিজ হলের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এই গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে প্রতিটি ব্যাচ থেকেই প্রার্থী দাঁড় করিয়ে হলে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে চায়।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—৪৭তম ব্যাচে উল্লেখিত এলাকাগুলোর ১ জন প্রার্থী, ৪৮তম ব্যাচে রয়েছে ১ জন, ৪৯তম ব্যাচে রয়েছে ৩ জন এবং ৫০তম ব্যাচেও রয়েছে ১ জন প্রতিনিধি পদপ্রার্থী শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতিটি ব্যাচে ধারাবাহিকভাবে প্রার্থিতা দেওয়ার এই প্রবণতা আসলে এক পরিকল্পিত কৌশল, যার মাধ্যমে হলে গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহীদ আজিজ হলের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ৫ আগস্টের পর র্যাগিং ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও আজিজ হলে প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটছে—কার ছত্রছায়ায় এসব হচ্ছে, সেটা জানা দরকার।
আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, ঘটনার কিছুদিন আগেই কিছু সিনিয়র শিক্ষার্থীকে একটি রাজনৈতিক দলপন্থী নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা গেছে। তাই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
নির্বাচন কমিশনের সদস্য সাঈফ মাহমুদ জানান— ২৩ তারিখ রাতে অভিযোগ পেয়ে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই। পরদিন সকালে মিটিংয়ে ৫০তম ব্যাচ নির্বাচন বাতিলের দাবি জানায় এবং লিখিত অভিযোগ দেয়। সবকিছু পর্যালোচনায় নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. এমদাদ সরকার বলেন— প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, যাদের বিরুদ্ধে হুমকি ও র্যাগিংয়ের অভিযোগ এসেছে, তারা অভিযোগকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন।
তাদের ভাষ্য— বুটেক্স সাংবাদিক সমিতির গ্রুপে যে পোস্ট দেওয়া হয়েছে, তাতে ঘটনাকে অতিরঞ্জিত ও বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় থাকা কিছু প্রার্থী পরিকল্পিতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।
তাদের আরও অভিযোগ— ঘটনার রাতে আমরা হলে অবস্থান করছিলাম। অথচ আমাদের ডেকে কোনো ব্যাখ্যা শোনা হয়নি। এরপরদিন সকালে হল প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্ট আমাদের কথা না শুনেই হল থেকে বহিষ্কার করে এবং শনিবারের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেন।
তবে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে হল প্রশাসন জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৫০তম ব্যাচের প্রায় ৩৪ জন ছাত্র এসে অভিযোগ জানায় এবং সাক্ষ্য দেয়। পরবর্তীতে অভিযুক্তরাও তাদের দোষ স্বীকার করে। আর হল ত্যাগের ব্যাপারে যা বলা হচ্ছে, তার অফিসিয়াল নোটিশ এখনো আসে নি। আমরা তদন্ত করবো এবং তদন্তের সাপেক্ষে প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেয় তা জানানো হবে।
হলের দেয়ালে এখনও লেগে আছে সেই রাতের উত্তেজনার ছাপ। চায়ের দোকানের বেঞ্চে, এক্সটেনশনের বন্ধ দরজার ওপাশে, আর ফিসফিসে কথোপকথনের ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটাই গল্প—কে কার হয়ে দাঁড়ালো, আর কে দাঁড়াতে গিয়েও হার মানলো চাপের মুখে। নির্বাচন স্থগিত হয়েছে—কিন্তু গোষ্ঠীগত দাপট থামেনি। ছায়া-রাজনীতি এখনও হাঁটছে আজিজ হলের করিডোরে।
আসিফ