
.
লসিকা, লসিকাবাহী নালী এবং লসিকাগ্রন্থি নিয়ে গঠিত লসিকাতন্ত্র ‘লিম্ফোসাইটস’ বা শ্বেতকনিকানামক রোগ-প্রতিরোধক কোষকলা উৎপাদন করে যেগুলো সংক্রামক বস্তুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শরীরকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। কিন্তুলসিকাগ্রন্থিগুলো নিজেরাই কখনো কখনো ক্যান্সার দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। শ্বেতকনিকাগুলো যদি স্বাভাবিক অবস্থায় না থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দ্রুত বর্ধনশীল ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হতে থাকে তখন তাকে প্রাথমিক ‘লিম্ফোমা’ আরঅন্য কোন অঙ্গ থেকে উদ্বুদ্ধ ক্যান্সার লসিকাতন্ত্রে ছড়িয়ে পরলে তাকে গৌণ ‘লিম্ফোমা’ বলা হয়।
নন-হজকিন এবং হজকিন এই দুই ধরনের ‘লিম্ফোমা’র মধ্যে ৯০ শতাংশই নন-হজকিন ‘লিম্ফোমা’।নন-হজকিন ‘লিম্ফোমা’র ৪০টি উপ-ধরন। সংক্রমণের ধরন, ক্যান্সারের অবস্থান, বৃদ্ধি, বিস্তৃতির দ্রুততা ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে উপ-ধরনগুলো নির্ণয় করা হয় যাদের চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন হয়ে থাকে। সাধারনত ৬০-৭০ বৎসর বয়সীরা নন-হজকিন এবং ২০-৪০ বছর বয়সীরা হজকিন লিম্ফোমা দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয়।
হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে ‘এপস্টাইন-বার-ভাইরাস’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত ‘রিড-স্টেমবার্গ কোষকলা’ নামক এক বিশেষ ধরনের কোষকলা জড়িত তাই পূর্বে এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিতদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নন-হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে ‘এপস্টাইন-বার-ভাইরাস’ থাকে না কিন্তু বি-কোষ ও টি-কোষের বর্ধিত বিস্তার ঘটতে দেখা যায়।
কারণ:নিশ্চিত কারণ এখনো জানা না গেলেও বিশেষ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে: (১) ইতোপূর্বে পরিবারের কোন সদস্য এই রোগে আক্রান্ত হলে (২) দুর্বল রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা (৩) অটোইমমিউন রোগ বা ‘এইচআইভি’ বা অন্য কোন ভাইরাসে আক্রান্তরা (৫) অতি মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা বা ক্ষতিকারক কোন রাসায়নিক দ্বারা অধিক সম্পাতিতরা।
লক্ষণ : এক বা একাধিক লসিকাগ্রন্থি ব্যথা ছাড়া বা ব্যথাসহ ফুলে ওঠা। হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে গলা, বুক, বা বোগলের লিম্ফনোড থেকে শুরু হয়ে পরবর্তীতে বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। নন-হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে শরীরের যে কোনো লিম্ফনোড থেকেই শুরু হতে পারে। বারবার জ্বর আসা, পেট ফুলে ওঠা, অস্বাভাবিকভাবে ঘেমে যাওয়া বিশেষ করে রাতে ঘুমের সময়, ক্লান্তিবোধ, ক্ষুধামন্দা, সহজেই রক্তক্ষরণ, ব্যায়াম বা ডায়েটিং ছাড়াও ওজন হ্রাস, ঘন ঘন সংক্রমণ, কাশি, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ফুসকুড়ি, চুলকানি ইত্যাদি এই রোগের লক্ষণ।
রোগ-নির্ণয় : প্রাথমিকভাবে রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করা হয়। সন্দেহজনক কিছু দেখা গেলে বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্ত পরীক্ষার মধ্যে সম্পূর্ণ রক্ত গণনা : রক্ত ও অস্থিমজ্জার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারনা লাভ, সংক্রমণের বিরুদ্ধে রক্তের বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা ও অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় করা (২) রক্তে সংক্রমণের মাত্রা যাচাইয়ের জন্য ‘ইএসআর’ টেস্ট (৩) রক্তে অস্বাভাবিক ধরনের আমিষের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য ‘সেরাম প্রোটিন ইলেকট্রোফোরেসিস’ বা এসপিইপি টেস্ট, কোষকলার জন্ম-মৃত্যুর হার নর্ণয়ের জন্য ‘এলডিএইচ টেস্ট’ করা হয়। এছাড়া লিভার এবং কিডনির কার্যক্ষমতা নির্ণয়ের জন্যও রক্ত পরীক্ষা করা হয়।
ইমেজিং টেস্ট: ক্যান্সারের ধরন, বিস্তৃতি এবং চিকিৎসা পরবর্তীতে ক্যান্সারের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যালোচনা ও ফলপ্রসূতা নির্ণয় অথবা ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন ইমেজিং পদ্ধতি সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে।
সিটি স্ক্যানার দ্বারা লিম্ফনোড, প্লিহা বা অন্যান্য অঙ্গের স্ফীতি বা আকার পর্যবেক্ষণ করা যায়। নরম কোষকলার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে অধিক কার্যকর ‘এমআরআই’ অস্থিমজ্জা, কেন্দ্রীয় ¯œায়ুতন্ত্রসহ অন্যান্য অঙ্গে ক্যান্সারের বিস্তৃতি নির্ণয়ে সহায়ক। কার্যকারিতা নির্ণয়ক পদ্ধতি ‘পেট’ ত্রিমাত্রিক রঙিন ছবির মাধ্যমে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয়ে পারদর্শী। তাই পেট-সিটি অথবা পেট-এমআরআই এর সমন্বয়ে গঠিত পদ্ধতিতে আক্রান্ত স্থানকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা ছাড়াও ক্যান্সারের বিস্তৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
বায়োপসি: বায়োপসিকে ক্যান্সার নির্ণয়ের মানদÐ হিসেবে ধরা হয়। ক্যান্সার এবং ক্যান্সার-মুক্ত কোষের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়, ক্যান্সারের বিস্তৃতি, ধরন, ধাপ ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে বায়োপসি করা হয়। ক্যান্সার অন্য কোন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার সন্দেহ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে একাধিক বায়োপসি করার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়।
এক্সসিশনাল বায়োপসি: অস্ত্রপোচারের মাধ্যমে সন্দেহজনক স্থান বা লিম্ফনোড সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করে পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ইনসিশনাল বায়োপসি: ক্যান্সারটি খুব বড় হলে, জটপাকানো থাকলে, কোন কারণে সম্পূর্ণ অপসারণ অসুবিধাজনক হলে অথবা লিম্ফোমার উপস্থিতি ত্বকে বা ত্বক সংলগ্ন এলাকাতে হলে সেক্ষেত্রে লিম্ফনোড বা টিউমারের অংশবিশেষ কেটে এনে বিশ্লেষণ করা হয়। বিশেষ করে নন-হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বেশি প্রযোজ্য। ‘কোর নিডল’ এবং ‘ফাইন নিডল’ ইনসিশনাল বায়োপসির অন্তর্ভুক্ত।
ফাইন নিডল বায়োপসি: একটি সূ² সুচ দ্বারা সন্দেহজনক স্থান থেকে কোষকলা বা তরলজাতীয় পদার্থ বের করে আনা হয়।
কোর নিডল বায়োপসি: স্থানীয় চেতনানাশক দ্বারা বাজটিল ক্ষেত্রে রোগীকে সম্পূর্ণ অচেতন করেআল্ট্রাসাউন্ড বা সিটি স্ক্যানারের সাহায্যেসঠিক স্থানে একটি মোটা ফাঁপা সুচ স্থাপন করে তার সাহায্যে নলের আকৃতিবিশিষ্ট কোষ কলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিস্তৃত এলাকার নমুনা সংগৃহীত হওয়ায় এই পদ্ধতিতে বেশি পরিমাণে তথ্য পাওয়া যায়।
অস্থিমজ্জার বায়োপসি দ্বারা অস্থিমজ্জায় ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্ণয়, লিম্ফোমার উপ-প্রকার এবং ধাপ নির্ণয়ের জন্য বিশেষ করে নিতম্বের হাঁড়ের ভেতর থেকে অস্থিমজ্জার মধ্যস্থ তরল কোষকলা এবং হাঁড়ের কোষকলার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ত্বকের পাঞ্চ বায়োপসির ক্ষেত্রে বৃত্তাকার একটি যন্ত্র ব্যবহার করে অথবা শল্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত ছুরির সাহায্যে ত্বকের ক্ষুদ্র অংশ কেটে এনে অথবা শেভ বায়োপসিতে ত্বকের উপরিতল থেকে চেঁছে কোষকলা সংগ্রহ কওে বিশ্লেষণ করা হয়।
চিকিৎসা: বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ক্যান্সারের অবস্থান, ধরন, বিস্তৃতি ও ধাপ সঠিকভাবে নির্ণয়ের পর চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়।
অপারেশন: সাধারণত অপারেশনের দ্বারা এই ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন; কোন একটি লিম্ফনোডের ক্যান্সার মারাত্মক হয়ে উঠলে, শরীরের স্বাভাবিক কার্য সম্পাদন যেমন; মল-মূত্র ত্যাগ বা শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হলে অথবা কেমোর দ্বারা প্রভাবিত না হলে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।
কেমোথেরাপি: লিম্ফোমার ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি পদ্ধতিতেই বেশি চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যা মুখে খাওয়ানো বা ইনজেকশন আকারে হতে পারে। প্রাথমিক মাত্রার কেমো কম কার্যকর হলে মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। কখনো কখনো একই সাথে অন্য কোনো থেরাপিও প্রয়োগ করা হয়।
রেডিয়েশন থেরাপি: প্রাথমিক অবস্থার হজকিন লিম্ফোমা এবং নন-হজকিন ক্যান্সারে বিশেষভাবে স্ফীত লিম্ফনোড এবং অঞ্চল বিশেষে অবস্থিত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়াগ করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি: ক্যান্সার কোষকলার জেনেটিক পরিবর্তন অথবা নির্দিষ্ট কোন আমিষকে ধ্বংস করতে বা বিস্তৃতি ঠেকাতে কেমোথেরাপির সাথে টার্গেটেড থেরাপি প্রয়োগ করা হয় যা চিকিৎসাকে অধিকতর কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করে। ইম্মিউন থেরাপি: শরীরের নিজস্ব রোগ-প্রতিরোধকতন্ত্রের কোষকলাগুলোকে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকলাগুলোকে চিহ্নিত করতে এবং এগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে তোলা হয়।
অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপন: চিকিৎসার পর ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তি ঘটলে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে প্রায়ই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সুস্থ ব্যক্তির অস্থিমজ্জা নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির অস্থিমজ্জায় প্রতিস্থাপন করা হয়।
পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া: সব ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যেমন; দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, অরুচি, বমিভাব, ডায়রিয়া, স্থায়ী বা অস্থায়ী বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে যেগুলোর প্রকোপ চিকিৎসা শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে কমে যায়।
উপশমকারী চিকিৎসা: এই চিকিৎসার দ্বারা নিরাময় যোগ্য বা নিরাময় অযোগ্য রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন বা চিকিৎসা শেষে ব্যথা, কষ্ট ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা লাঘব কওে রোগীর জীবন-মান কিছুটা উন্নত করে আনার লক্ষ্যে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক বা আত্তিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করা হয়। কষ্ট উপশমকারী ওষুধ প্রয়োগ, রেডিয়েশন থেরাপীর দ্বারা টিউমারের আকৃতি হ্রাস, ম্যাসাজ, আকুপাংচার ইত্যাদি এই চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত।
রোগের পূর্বাভাস: হজকিন লিম্ফোমার ক্ষেত্রে সব বয়সীদের জন্যই অন্তত ৫ বছর পর্যন্ত বাঁচার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণিত এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেসম্পূর্ণভাবে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা খুবই বেশি।
নন-হজকিন লিম্ফোমায় আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ক্যান্সারের ধরন, ধাপ, রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসার প্রতি রোগীর প্রতিক্রিয়াশীলতার ওপর নির্ভর করে। আঞ্চলিক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার হার ৮৩ শতাংশ। এমনকি বিস্তৃত ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫ বছর পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ এবং ১০ বছর বা আরও বেশি সময় পর্যন্ত ৫৫ শতাংশ।
লেখক : মেডিক্যাল ফিজিসিস্ট এবং অধ্যাপক ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ,
মোবাইল: ০১৯১১৩৬৪১০৩।
প্যানেল মজি