
নাম শুধু একটি পরিচয় নয়, বরং তা একজন মানুষের জীবনব্যাপী সঙ্গী এবং মৃত্যুর পরও তার স্মৃতিকে ধারণ করে রাখে। ইসলামে সন্তানের নামকরণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়, কারণ এটি শুধু একটি ডাকনাম নয় বরং তার পরিচয়, ধর্মীয় ভিত্তি এবং ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল অনেক মুসলিম পরিবারে এমন সব নাম রাখা হচ্ছে যেগুলো শুনে বোঝা যায় না শিশুটি আসলে কোন ধর্মের অনুসারী। আবার অনেক সময় কোরআনের যেকোনো শব্দ দিয়ে নাম রাখার প্রবণতাও দেখা যায়, অথচ সব কোরআনিক শব্দই যে নাম হিসেবে গ্রহণযোগ্য তা নয়। কোরআনে ফেরাউন, ইবলিস, হামান, কারুন, আবু লাহাব এদের নামও আছে। এসব নাম সন্তানের জন্য রাখা যেমন অনুচিত, তেমনি কুরআনের যে কোনো শব্দকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নাম হিসেবে গ্রহণ করাও ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী।
নবজাতকের নামকরণের সুন্নত ও হাদিসের দিক নির্দেশনা
ইসলামী বিধান অনুযায়ী, নবজাতকের জন্মের তৃতীয় অথবা সপ্তম দিনে একটি সুন্দর, অর্থবোধক ও শ্রুতিমধুর নাম রাখা সুন্নত। এ দায়িত্ব মূলত পিতা-মাতার। হাদিসে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, সন্তানের সুন্দর নাম রাখা এবং উত্তম লালনপালন করা পিতার কর্তব্য।
নাম রাখার সময় চাইলে দাদা-দাদী, নানা-নানী কিংবা অন্যান্য আত্মীয়দের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। তবে প্রস্তাবিত নামগুলো কোনো অভিজ্ঞ আলেমের কাছে পর্যালোচনা করা উচিত। নামটি যেন ভালো অর্থপূর্ণ, সহজ ও শ্রুতিমধুর হয়, সেটিও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
নামের প্রভাব ও নবীজির সংশোধন উদাহরণ
হাদিসে নামের প্রভাব সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। এক সাহাবী নবীজিকে জানালেন, তার নাম ‘হাজান’ (শক্তভূমি)। নবীজি তা পরিবর্তন করে ‘সাহল’ (নরম জমিন) রাখার পরামর্শ দেন। কিন্তু সাহাবী বলেন, “আমার পিতা যে নাম রেখেছেন তা আমি পরিবর্তন করব না।” এতে পরবর্তীতে তাদের বংশে রুক্ষতা ও কর্কশতা দেখা দেয়।
আরেক হাদিসে, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় কাফের প্রতিনিধি ‘সুহাইল’ (সহজকারী) আসলে, নবীজি তার নাম শুনে বলেন, “সুহাইল তোমাদের জন্য বিষয়গুলো সহজ করতে এসেছে।”
আধুনিক সমাজে নামের বিচিত্রতা ও গড়পড়তা প্রবণতা
বর্তমান বাংলার মুসলিম সমাজে অনেকের নাম বাবু, খোকা, মানিক, রতন, খোকন, রাজা, বাদশা, প্রিন্স ইত্যাদি। কেউ কেউ নাম রাখেন প্রকৃতির অনুকরণে আকাশ, সাগর, বর্ষা, হিমেল, চৈতি, কিংবা রঙের নাম—নীল, গোলাপি, সবুজ ইত্যাদি। আবার এমনসব নামও রাখা হয় যেগুলোর কোন অর্থই নেই, যেমন: বল্টু, পল্টু, সনেট, বুলেট। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে এসব নাম গ্রহণযোগ্য নয়।
আল্লাহর সঙ্গে ‘আবদ’ শব্দের ব্যবহার ছাড়া অন্যত্র নয়
‘আব্দুল্লাহ’ ও ‘আব্দুর রহমান’ নামদ্বয় আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কারণ এতে আল্লাহর দাসত্বের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু ‘আব্দুল কালাম’, ‘আব্দুর রাসূল’, ‘আবদুল হাযার’—এ ধরনের নামগুলো ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূল (সা.) এমন নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন।
কোরআন থেকে শব্দ নিয়ে নাম রাখার আগে সচেতনতা জরুরি
অনেক অভিভাবক কোরআন থেকে শব্দ নিয়ে নাম রাখতে চান। ভালো উদ্যোগ হলেও, নাম হিসেবে গ্রহণযোগ্য কিনা, তা যাচাই করা জরুরি। যেমন: কেউ কোরআনের আয়াত থেকে ‘জিদনি’ বা ‘ইলমা’ শব্দ নিয়ে নাম রাখছেন—যার মানে ‘আমাকে বৃদ্ধি দাও’ ও ‘জ্ঞান’। এসব শব্দ নাম হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়।
বংশ পরিচয়ে পিতার নাম ব্যবহার করা উত্তম
হাদিসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন ডাকা হবে, “অমুকের ছেলে অমুক।” তাই সন্তানের নামের সঙ্গে পিতার নাম যুক্ত করা উত্তম, যেমন সাহাবীদের নামেও দেখা যায়। তবে মায়ের নাম যুক্ত করার বিধান ইসলামে নেই, আবার বাধাও নেই যদি তা অর্থহীন বা বিভ্রান্তিকর না হয়।
নাম শুধু উচ্চারণের বিষয় নয়, বরং তা ব্যক্তি ও জাতির পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই সন্তানের নামকরণে আবেগ নয়, বরং দায়িত্বশীলতা ও ইসলামি জ্ঞান চর্চা অত্যন্ত জরুরি। একজন প্রকৃত আলেমের পরামর্শ ছাড়া কোনো শব্দকে নাম হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়। ইসলাম চায় পরিচ্ছন্ন পরিচয়, সুস্পষ্ট ধর্মীয় চিহ্ন ও পরিচয়বাহী একটি সুন্দর ও অর্থবোধক নাম।
Jahan