
ঈদ-উল-ফিতর ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রধান উৎসব। অটোমান সাম্রাজ্যে এই উৎসবকে বলা হতো "রমজান বায়রাম" বা "সেকার বায়রাম"। তুর্কি ভাষায় বায়রাম শব্দের অর্থ “উৎসব” আর সেকার অর্থ “মিষ্টি”। তাই এই উৎসব যেমন ছিল ধর্মীয়, তেমনি ছিল রাজকীয় মিষ্টিময় আয়োজনে ভরপুর।
ছয় শতাব্দীব্যাপী (১৩০০–১৯২৪) রাজত্ব করা অটোমানরা ঈদের দিনটিকে ঘিরে করতেন বিপুল আয়োজন। তুর্কি ভাষায় যেটি “ওসমানী সাম্রাজ্য” নামে পরিচিত, সেই ঐতিহাসিক শক্তির রাজধানী ইস্তাম্বুলে ঈদের চাঁদ দেখা মাত্রই শুরু হতো আনুষ্ঠানিকতা।
চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হতো উৎসব
ঈদের চাঁদ দেখা গেলে দুটি ভিন্ন স্থান থেকে তিনবার করে তোপধ্বনির মাধ্যমে ঈদের সূচনা ঘোষণা করা হতো। পরদিন ঈদের নামাজের সময়েও শহরের গুরুত্বপূর্ণ প্রাসাদ ও এলাকা থেকে তোপ দাগা হতো।
বিশেষভাবে আলোকসজ্জা করা হতো তোপকাপি প্রাসাদে। চাঁদরাতে মশালের আলোয় ঝলমল করতো রাজপ্রাসাদ।
সুলতানের ঈদের রীতি
ঈদের সকালেই সুলতান তার বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন নামাজের উদ্দেশ্যে — সাধারণত হায়া সোফিয়া কিংবা নীল মসজিদে।
রাজকীয় শোভাযাত্রা দেখতে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় ভিড় করতেন সাধারণ মানুষ। শোভাযাত্রার নিরাপত্তায় থাকতেন প্রহরীরা। নামাজ শেষে সুলতান ফিরতেন প্রাসাদে, বসতেন সিংহাসনে এবং শুভেচ্ছা গ্রহণ করতেন রাজপুত্র, কর্মকর্তারা এবং হারেমের সদস্যদের কাছ থেকে।
রাজপ্রাসাদে মিষ্টিমুখ ও ভোজ
ঈদের বিশেষ মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হতো সোনা ও রুপার থালায়। এরপর সুলতান যেতেন সমুদ্রতীরবর্তী প্রাসাদে, যেখানে আয়োজিত হতো ক্রীড়াবিষয়ক বিনোদন — কুস্তি, লক্ষ্যভেদ, তীর-ধনুক, বন্দুক, বর্শা প্রদর্শনী।
বিশেষ প্যাভিলিয়নে বসতেন রাজা-উজির ও অতিথিরা। শহর সাজানো হতো বর্ণিল সাজে। শিশুদের জন্য দোলনার ব্যবস্থা থাকত। আয়োজনের মধ্যে থাকত বই বাঁধাইয়ের প্রদর্শনীও।
জায়গাগুলো জাল দিয়ে ঘেরা থাকত, যাতে হারেমের নারীরাও ভেতর থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারেন।
সুলতানের উপহার ও নারীদের সাজ
ঈদের দিনে সুলতান সবার মাঝে উপহার বিতরণ করতেন। যেমন, সুলতান সুলেমান তার স্ত্রী হুররাম সুলতানকে উপহার দিতেন পান্না ও রুবি খচিত মুকুট। হুররাম পরতেন সূক্ষ্ম কাজের পোশাক ও গয়না।
নারীদের মাঝে মেহেদির চল ছিল। ঐতিহাসিক আহমেদ বিন মুস্তফা জানান, জটিল নকশার মেহেদি আঁকতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগত।
সাধারণ মানুষের ঈদ
সাধারণ পরিবারগুলোতেও ছিল ঈদের সাজ। শিশুরা নতুন জামা পরে বেড়াতো। নারীরা গয়না ও মেহেদিতে সেজে উঠতেন। পরিবারে ছোটরা বড়দের হাত চুমু দিয়ে সালাম জানাত, বড়রা মিষ্টি দিয়ে তার জবাব দিতেন।
জোহরের নামাজের পর কবরস্থানে গিয়ে প্রার্থনা করার রীতি তখনও প্রচলিত ছিল।
নাট্য পরিবেশন ও বিদেশি অতিথি
সাম্রাজ্যের শেষ দিকে, দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের আমলে, ঈদে নাট্য পরিবেশন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিদেশি কূটনীতিকদেরও নাটকে আমন্ত্রণ জানানো হতো।
ঈদের সময় নৌবাহিনীতে উপকূলভিত্তিক উৎসব, নগরজুড়ে খেলাধুলার অনুমতি ও অল্প খরচে বিনোদনের সুযোগ ছিল। বিদেশিরাও এই রাজকীয় আয়োজন দেখতে আসতেন ইস্তাম্বুলে।
দীর্ঘ ঐতিহ্যের সমাপ্তি
১৩ শতকে ওসমান গাজীর হাতে গড়া এই সাম্রাজ্য ১৯২৪ সালে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু অটোমানদের ঈদ উদযাপনের রাজকীয় ও মানবিক ঐতিহ্য ইতিহাসে অমলিন হয়ে রইল।
Jahan