
ছবি: সংগৃহীত
আপনজন মারা গেলে শোক ভারে চোখ ভিজে ওঠে, বুক ফেটে কান্না আসে— এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের কিছু অঞ্চলে দেখা যায়, শোকের এই প্রকাশটিও "ভাড়ায়" আনা হয়। অবাক হলেও সত্যি, রাজস্থানের একটি সম্প্রদায়ের নারীদের পেশাই হলো মৃতের বাড়িতে গিয়ে কান্নার অভিনয় করা। এই বিচিত্র পেশাজীবী নারীদের বলা হয় রুদালী, যার আক্ষরিক অর্থ— "কান্নারত নারী"।
বহুকাল ধরেই এই সম্প্রদায়ের নারীদের পেশা হয়ে উঠেছে কান্না বেচে জীবন চালানো। কেউ মারা গেলে, বিশেষ করে সমাজের উচ্চবর্ণের কেউ, তখন রুদালীরা গিয়ে চোখের জল ফেলেন, বুক চাপড়ান, চুল ছিঁড়েন এবং কান্না-কাটিতে বাড়ির বাতাস ভারী করে তোলেন।
এই কান্না একদম অভিনয় হলেও তা অত্যন্ত নাটকীয় ও হৃদয়বিদারক হয়, যেন সত্যিই শোক ভর করেছে তাদের মনেও।
গবেষকদের মতে, এই প্রথা মূলত গড়ে উঠেছে ভারতের রাজস্থান ও পশ্চিম ভারতের গ্রামীণ এলাকায়, বিশেষ করে ঠাকুর বা রাজপুত সমাজে। এই সমাজের পুরুষেরা আবেগ প্রকাশ করাকে দুর্বলতা মনে করতেন। মৃত্যুর পরও তাঁরা প্রকাশ্যে কান্না করতেন না বা শোক দেখাতেন না।
তাই পরিবারের সদস্যদের শোক ‘প্রকাশ’ করার দায়িত্ব দেওয়া হতো এই রুদালীদের উপর। শোক প্রকাশ হতো— কিন্তু পরিবার নিজেরা নয়, ভাড়াটে কান্নার মাধ্যমে।
রুদালীরা সাধারণত সমাজের নিম্নবর্ণের, দরিদ্র, বিধবা বা পরিত্যক্ত নারী— যারা বেঁচে থাকার তাগিদে এই কাজকে জীবিকার উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তবে এই পেশাকে সমাজে খুব একটা সম্মানজনক চোখে দেখা হয় না, বরং অনেক সময় অপমান, লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাদের।
এই রুদালীদের জীবনের ছায়া পড়ে সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রেও। ১৯৭৯ সালে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘রুদালী’ নামক বাংলা ছোটগল্প এই পেশাজীবীদের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে সেটি হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয় এবং বিখ্যাত নির্মাতা কাল্পনা লাজমি এই গল্প নিয়েই নির্মাণ করেন ‘রুদালী’ নামের চলচ্চিত্র, যাতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ডিম্পল কাপাডিয়া।
আজকের দিনে দাঁড়িয়েও রাজস্থানের কিছু অঞ্চলে এই রীতি টিকে আছে। পেশা হিসেবে যতই অদ্ভুত শোনাক না কেন, এই কান্না বিক্রির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক শ্রেণির নারীর কঠিন বাস্তবতা, নিপীড়নের ইতিহাস এবং বেঁচে থাকার এক করুণ সংগ্রাম।
শেখ ফরিদ