
ছবিঃ সংগৃহীত
চোখকে অনেক সময় আত্মার জানালা বলা হয়। তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, চোখ হতে পারে হৃদয়ের জানালাও। গবেষক ও চিকিৎসকরা এখন চোখের রেটিনায় থাকা ছোট রক্তনালিগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। কারণ, এই ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলোর ক্ষতি হৃদযন্ত্রের অবস্থাকেও ইঙ্গিত করতে পারে।
রেটিনার মাধ্যমে শরীরের মাইক্রোভাসকুলার সিস্টেম বা অতি ক্ষুদ্র রক্তনালির গঠন সরাসরি দেখা সম্ভব, যা হৃদয়ের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে চোখে ক্ষতি দেখা দিলে তা অনেক সময় হৃদয় বা মস্তিষ্কের ভেতরের রক্তনালির অবস্থাকেও প্রতিফলিত করে। তাই চোখকে এখন বিবেচনা করা হচ্ছে কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য নির্ধারণে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে।
উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ কারণে শুধু রক্তচাপ মেপে ঝুঁকি নির্ধারণ করলেই চলবে না, বরং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে উচ্চ রক্তচাপজনিত ক্ষতি (Hypertension Mediated Organ Damage বা HMOD) হয়েছে কি না, তা-ও দেখা প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে চোখের রেটিনার ক্ষুদ্র রক্তনালিতে প্রভাব পড়ে, যাকে বলা হয় হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি। এ অবস্থা একদিকে যেমন দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে হৃদরোগেরও ইঙ্গিত দেয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
হাইপারটেনসিভ চোখের রোগ
উচ্চ রক্তচাপজনিত চোখের রোগ মানে এমন সব সমস্যা যা দীর্ঘ সময়ের হাই ব্লাড প্রেসারের কারণে চোখে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি, যেখানে চোখের রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়াও, হাইপারটেনসিভ কোরয়েডোপ্যাথি (চোখের রেটিনার নিচের রক্তবাহী স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া) এবং হাইপারটেনসিভ অপটিক নিউরোপ্যাথি (অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া)-র মতো জটিলতাও দেখা দিতে পারে।
চোখের এই ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলো গঠনগত দিক থেকে হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক এবং কিডনির রক্তনালির সঙ্গে বেশ মিল রাখে। তাই চোখ পরীক্ষা করেই শরীরের অন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আগাম ধারণা পাওয়া সম্ভব।
প্রযুক্তির সহায়তায় নতুন সম্ভাবনা
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন অ্যাডাপটিভ অপটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে রেটিনার গভীর পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে চোখ এখন শুধু দৃষ্টি যাচাইয়ের অঙ্গ নয়—হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা ও মস্তিষ্কের রোগ বুঝতেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
রেটিনাল ভেইন অক্লুশন (RVO): অদৃশ্য ঝুঁকি
রেটিনার রক্তনালিতে হঠাৎ ব্লক হয়ে গেলে রেটিনাল ভেইন অক্লুশন (RVO) ঘটে। এতে এক চোখে হঠাৎ করে ব্যথাবিহীনভাবে দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে। এটি বিশ্বের একক চোখ অন্ধত্বের পাঁচটি প্রধান কারণের মধ্যে একটি।
এই সমস্যায় ফান্ডাস পরীক্ষায় দেখা যায় রক্তক্ষরণ, রেটিনা ও নার্ভের ফোলাভাব এবং শিরা স্ফীত হওয়া। রোগের জটিলতা হিসেবে নিওভাসকুলারাইজেশন (অতিরিক্ত রক্তনালি গঠনের প্রবণতা) ও গ্লকোমা (চোখের চাপে সমস্যা) দেখা দিতে পারে, যা দৃষ্টিশক্তির জন্য মারাত্মক হুমকি।
চোখ ও হৃদয়ের ক্ষুদ্র রক্তনালির সংযোগ
চোখ, মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ের ক্ষুদ্র রক্তনালির গঠন প্রায় অভিন্ন। গবেষণায় দেখা গেছে, চোখের রক্তনালির ক্ষয় বা অস্বাভাবিকতা থাকলে অনেক সময় তা উচ্চ রক্তচাপ, আর্টারির শক্ত হয়ে যাওয়া (Atherosclerosis) ইত্যাদির লক্ষণ হয়ে থাকে।
Journal of the American Medical Association (JAMA)-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, চোখের রেটিনার পরিবর্তনগুলো অনেক সময় হৃদরোগের পূর্বাভাস হিসেবে কাজ করে। এমনকি হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইলিওর এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে।
MESA Study-তেও দেখা গেছে, চোখের রেটিনায় পরিবর্তন হৃদপিণ্ডের ধমনিতে ক্যালসিয়াম জমা ও রক্তপ্রবাহে সমস্যা তৈরির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ফলে, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা শুধু দৃষ্টিশক্তির জন্য নয়, হৃদয়ের সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
উপসংহার
চোখের মধ্যে লুকিয়ে আছে হৃদরোগের অনেক অজানা বার্তা। চোখের রক্তনালির ক্ষতি দেখা দিলেই সেটা হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের আগাম সতর্কবার্তা। তাই যারা উচ্চ রক্তচাপের রোগী বা হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন, তাদের জন্য চোখ পরীক্ষা হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপ।
ইমরান