
আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি হবে মেধায় ভরপুর, আত্মবিশ্বাসী ও মনোযোগী? তার ভিত্তি তৈরি হয় জন্মের বহু আগেই গর্ভাবস্থাতেই। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে শুধু জন্মের পরের পরিচর্যাই যথেষ্ট নয়, গর্ভাবস্থায় মায়ের খাদ্যাভ্যাস, মানসিক অবস্থা এবং পরবর্তী সময়ে শিশুর ঘুম, খাদ্য, খেলাধুলা ও পারিবারিক পরিবেশ,সব মিলিয়েই গড়ে ওঠে এক পূর্ণাঙ্গ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকা।
গর্ভাবস্থা থেকেই সচেতনতা জরুরি
পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকার মতে, শিশুর ব্রেইনের গঠন শুরু হয় মায়ের গর্ভেই। এ সময় মায়ের খাবারে পর্যাপ্ত ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ফোলিক অ্যাসিড, আয়রন এবং আয়োডিন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, বাদাম, দুধ ও সবুজ শাকসবজি মস্তিষ্কের নিউরোন তৈরিতে সহায়তা করে। একইসঙ্গে গর্ভবতী মায়ের মানসিক শান্তিও শিশুর ভবিষ্যৎ মস্তিষ্কের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, এ সময় মায়ের মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা কিংবা উদ্বেগ শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্টকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলেও জানান তিনি। তাই গর্ভাবস্থায় ভালো গান শোনা, বই পড়া, হালকা হাঁটাহাঁটি ও পরিবারিক সাপোর্ট অত্যন্ত জরুরি।
জন্মের পর শিশুর খাবারে মস্তিষ্ক গঠনের উপাদান
জন্মের পর শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্টে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পুষ্টি। আয়শা সিদ্দিকা জানান, বয়স অনুযায়ী শিশুর খাবারে যেন পর্যাপ্ত প্রোটিন, ওমেগা-৩, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন-ডিম, মাছ, ডাল, দুধ, ঘরে তৈরি স্যুপ, রঙিন সবজি এবং মৌসুমি ফল শিশুর মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ও নিউরনের কার্যকারিতা উন্নত করে।
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি
পুষ্টিবিদ আয়শা বলেন, ঘুম শুধু বিশ্রামের জন্য নয়,এটি শিশুর ব্রেইনের তথ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে প্রি-স্কুল বয়সে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ঘুম না হলে শিশুর মনোযোগ কমে যেতে পারে, শেখার আগ্রহেও আসে নেতিবাচক প্রভাব। ঘুমের একটি নির্দিষ্ট রুটিন রাখা তাই আবশ্যক।
পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন শৈশবেই
বই পড়া শিশুদের কল্পনাশক্তি, ভাষাজ্ঞান ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। আয়শা সিদ্দিকা মনে করেন, শিশুকে যদি ছোটবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে পরিচিত করা যায়, তাহলে তার চিন্তাশক্তির বিকাশ হয় দ্রুত। ছোটদের উপযোগী রঙিন ছবি আর গল্পভিত্তিক বই দিয়ে শুরু করলে শিশুদের আগ্রহ জন্মায় স্বাভাবিকভাবে।
শেখার খেলার মাধ্যমে হোক বিকাশ
শিশুরা খেলতে খেলতেই শেখে। খেলনার মাধ্যমে শেখা, পাজল, রঙিন ব্লক তৈরি বা মেমোরি গেম শিশুদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও সৃজনশীলতা বাড়ায়। আয়শা জানান, এসব কার্যক্রম তাদের নিউরোনকে সক্রিয় রাখে এবং যুক্তি প্রয়োগের অভ্যাস তৈরি করে।
স্ক্রিন টাইম হ্রাস করুন, বাস্তব জগতে দিন সুযোগ
অতিরিক্ত মোবাইল, টিভি বা ট্যাব ব্যবহারে শিশুদের ব্রেইনের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য স্ক্রিন একেবারেই নিরুৎসাহিত করেন আয়শা। তিনি বলেন, বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার সুযোগ শিশুকে সামাজিকভাবে দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
ইতিবাচক পরিবেশ ও উৎসাহ শিশুর ভিত গড়ে তোলে
শিশুর ভুল হলে ধমক না দিয়ে তাকে বোঝানো এবং প্রশংসা করা শিশুর আত্মবিশ্বাস গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। আয়শা বলেন, সন্তানকে প্রশ্ন করতে, মত প্রকাশ করতে ও নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক দক্ষতা ও মস্তিষ্কের ভারসাম্য বজায় থাকে।
শারীরিক ব্যায়াম ব্রেইনের রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়
সকালের রোদে হাঁটাহাঁটি, পার্কে দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা এসব শুধু শরীরের জন্য নয়, ব্রেইনেরও খাবার। শারীরিক আন্দোলনের ফলে শিশুর ব্রেইনে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ে এবং মনোযোগ উন্নত হয়।
পরিবারের সময় ও কথা বলার গুরুত্ব
পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকা বলেন, প্রতিদিন কিছুটা সময় শিশুর সঙ্গে কথা বলা, তার কথা মন দিয়ে শোনা এবং তাকে গল্প শোনানো,এসব শিশুর ভাষাশক্তি, মনোযোগ এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। মায়ের মুখের ভাষাই প্রথম শেখা, তাই সময় দেওয়া শুধু দায়িত্ব নয়,ব্রেইনের বিকাশে অপরিহার্য।
একজন শিশু জন্মায় সম্ভাবনা নিয়ে, কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে পূর্ণ রূপ দিতে হলে দরকার সময়মতো সঠিক পরিচর্যা। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মা-বাবার যত্ন, সচেতনতা ও পরিবেশই পারে তার বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিকে শক্ত করে গড়ে তুলতে। আজ থেকেই শুরু হোক সেই সচেতন প্রয়াস।
সূত্র:https://tinyurl.com/2v2yvphj
আফরোজা