সুমী অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা থাকেন ইতালিতে। এই সুযোগে আধুনিকতার ছোঁয়া এবং হাতে মোবাইল। মোবাইলের মাধ্যমে এক ছেলের সঙ্গে টেলিফোনে কথা। তারপর পরিচয় এবং ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ঘটনাটি বাবা-মা জানার পর সুমীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ, মোবাইল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন তার কিছুদিন পরপর শ্বাসকষ্ট, হঠাৎ করে বড়-বড় করে শ্বাস ওঠা- নামা এবং দম নিতে পারে না। সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অক্সিজেন ও স্যালাইনের মাধ্যমে চিকিৎসা চলছিল। এত পরীক্ষা করার পরেও রোগ ধরা পড়ল না। পরে একজন ডাক্তারের পরামর্শক্রমে সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসায় সুমী এখন সুস্থ জীবনযাপন করছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই চিন্তায় পড়ে গেল- মেয়ের কি অসুখ হলো। আসলে সুমী হিস্টেরিয়া নামক রোগে ভুগছে।
হিস্টেরিয়ার কারণ কি
১. ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা, যেমন ধরুন সিডোরে সব গাছ ভেঙ্গে যায়নি কিন্তু গাছ উল্টিয়ে গেছে, গাছের ডাল ভেঙ্গেছে আবার কিছু গাছ ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি এই মেয়েদের ব্যক্তিত্ব দুর্বল থাকে যা তারা চাপের মুখে পড়লে সহজে ম্যানেজ করতে পারে না।
২.কোন সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, বিবাহসংক্রান্ত অথবা সেক্স সংক্রান্ত কোন ধরনের মানসিক চাপ যখন না পারে সহ্য করতে না পারে ম্যানেজ করতে, তখনই মনের দ্বন্দ্ব, দুঃখ যন্ত্রণা, হতাশ ক্ষোভ শরীরের লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়।
লক্ষণ
১. খিঁচুনি হওয়া
২. দাঁত লেগে যাওয়া
৩. শ্বাসকষ্ট (আগে কখনও ছিল না), হাঁপানী রোগের মতো, কিছুক্ষণ পর আবর স্বাভাবিক হয়ে যায়।
৪. কথা বলতে পারে না (আকারে- ইঙ্গিতে বলে, হাত দিয়ে দেখায়, কলম দিয়ে লিখে তার কথা প্রকাশ করে।
৫. হাঁটতে পারে না কিন্তু প্যারালাইসিস না এছাড়াও
৬. নাকায়ে নাকায়ে কথা বলে।
৭. গলায় দলার মতো কিছু মনে হয় অথচ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছুই ধনহড়ৎসধষ নেই ইএনটি ডাক্তার দেখানোর পরও রোগীরা আশ্বস্ত হয় না।
কাদের মধ্যে বেশি হতে পারে
১. মেয়েদের প্রায় ৭ গুণ বেশি হয়
২. ৩০ বছর বয়সের নিচে
৩. দরিদ্রতা একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা
৪. ছোট বয়সে মা-খালার মধ্যে এসব লক্ষণ দেখে আসছে এই রকম সন্তানদের মধ্যে বেশি হতে পারে।
৫. অল্প শিক্ষিতের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
৬. দীর্ঘদিন যাবত স্বামী বিদেশ থাকা।
৭. স্কুলে কোন শিক্ষক-শিক্ষিকার আচরণ, পথে রাস্তা ঘাটে কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যা কিরোশী মেয়েদের কাছে বড় বেদনাদায়ক, পরীক্ষার চাপ অথবা কোন কারণে স্কুলে ভয় পাওয়া ইত্যাদি।
রোগ সম্পর্কে সামাজিক ধারণা/ প্রচলিত ধারণা
এই হিস্টেরিয়া রোগীগুলো সমন্ধে এখনও আমাদের সমাজে কিছু প্রচলিত ধারণা বিদ্যমান। যেমন : ডাক্তার সাহেবরা বলেন- ও ভান করছে, নাকে নল দেও।
রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে বিশ্বাস যে জিনে পেয়েছে অথবা বাতাস লেগেছে, আলগা দোষ ইত্যাদি।
এর ফলে ফকির, কবিরাজ, ওঝাবিদ্যা ও মাজারে নিয়ে অপচিকিৎসা করা হয় এবং প্রতিদিন কু-চিকিৎসা ও অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে হাজার হাজার রোগী। রোগীর মধ্য লক্ষণ যতই আকার ধারণ করুক না কেন মোটেই ভাবনা নেইÑ এটা অবশ্যই রোগেরই একটি লক্ষণ থাকে। চিকিৎসকরা বলে লা বেলি ইনডিফারেন্স।
গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল নিম্নরূপ
১. ১-৩ বয়সের নিচে ৮৫%
২. মহিলাদের মধ্যে ৮৫.৭১%
৩. নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের মধ্যে ৮৫%
লক্ষণের মধ্যে
সাধারণত বেশি দেখা যায় ফিট/অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ৪০%
দাঁত লেগে যাওয়া ৭%
কথা বলে না (গঁঃব)১৪%
হাঁটতে পারে না/ হাঁটার সমস্যা/ পা প্যারালাইসিস ২৫%
উপরের চিত্র থেকে এটা পরিষ্কার যে, কম বয়স, গরিব অল্প শিক্ষিত ও মেয়েদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।
কারণের মধ্যে
দেখা গেছে যে, পারিবারিক দ্বন্দ্ব (১৭%), যৌন সম্পর্ক, স্বামী বিদেশ থাকা (১৭%), শ্বশুরবাড়ির অশুভ/অনাকাক্সিক্ষত ব্যবহার (১৪%), স্বামীর অবহেলা, স্বামীর ইমোশনাল সম্পর্ক ইত্যাদি।
মৃগী রোগীর খিঁচুনি এবং হিস্টেরিয়ার খিঁচুনির মধ্যে পার্থক্য
১ সত্যিকার অজ্ঞান হয়ে যায়Ñ সত্যিকার অজ্ঞান হয়ে যায় না
২. ঘুমের মধ্যে, জাগ্রত অবস্থায় হয়Ñ শুধু জাগনা অবস্থায় হয়।
৩. প্রসাব করে দিতে পারে Ñ প্রসাব করে না
৪. জিহবা কেটে ফেলে, শিশুরা জিহবা চাবায়- জিহবা কাটে না
৫. মনে করতে পারে নাÑ মনে করতে পারে কে তাকে তেল-পানি দিয়েছে।
অতএব হিস্টেরিয়া এক ধরনের মানসিক রোগ, এটা কোন জিন ভূত ও আলগা দোষ নয়।
ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: