
ছবি: সংগৃহীত
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ একটি অনন্য সম্পদ। এটি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এই চর্যাপদ রচিত হওয়ার পর তা বাংলায় সংরক্ষিত হয়নি, বরং তা নেপালে সংরক্ষিত হয়েছে।
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে বাংলার এক অন্ধকারময় যুগের ইতিহাস— মাৎস্যন্যায়। এই শব্দটি দ্বারা বোঝানো হয় এমন একটি সময় যখন শক্তিশালীরা দুর্বলদের গ্রাস করত, আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না এবং সমাজে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই অস্থির সময়ে বাংলার বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকরা তাদের ধর্মীয় ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপদ স্থান খুঁজতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত তারা নেপালে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই চর্যাপদ সংরক্ষিত হয়।
চর্যাপদের ইতিহাস বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের বাংলার দিকে। তখন বাংলা শাসন করছিলেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। তিনি একজন দক্ষ ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন এবং তার শাসনামলে বাংলা ছিল সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী। কিন্তু ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তার পুত্র মানবদেব রাজ্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হন এবং গৌড় রাজ্য ভেঙে পড়ে।
এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ছোট ছোট শক্তি উঠে আসে। প্রত্যেকে নিজের এলাকায় নিজেকে রাজা বলে দাবি করতে থাকে। একই সময়ে বাংলার উপর বহিরাগত আক্রমণও বাড়তে থাকে। কনৌজ, কাশ্মীর ও তিব্বতের শাসকরা বাংলায় আক্রমণ চালায় এবং এলাকাগুলো দখল করে নেয়। এই অরাজক পরিস্থিতিই ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত।
এমন সময়ে প্রকৃতিপুঞ্জ নামক সামাজিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে গোপালকে রাজা নির্বাচিত করা হয়। এভাবে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মীয় পাল শাসনের সূত্রপাত ঘটে। পাল শাসনামলেই চর্যাপদ রচনা শুরু হয় বলে অনুমান করা হয়। এরপর ক্রমে পাল শাসনের অবসান ও হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসনের সূচনা হলে বৌদ্ধ সহজিয়ারা চাপের মুখে পড়েন।
এই মাৎস্যন্যায় কাল শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেনি, এর প্রভাব পড়েছিল ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রেও। বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। বিশেষ করে সহজিয়া বৌদ্ধরা, যারা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশে ধর্মচর্চা করতেন, তারা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চোখে বিদ্রোহী হিসেবে দেখা দেন। সহজিয়া সাধকরা নারী-পুরুষের সমান অধিকার, সরল জীবনযাপন এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পথে চলতেন। কিন্তু এই আদর্শ গোঁড়া হিন্দুসমাজ মেনে নেয়নি। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মণদের হাতে সহজিয়া সাধকরা সমাজে নিগৃহীত হতে থাকেন। তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়ানো হয়, কেউ তাদের আশ্রয় দিত না এবং তাদের ধর্মাচরণকে পাপ হিসেবে দেখা হতো।
এই নিপীড়নের ফলে বাংলায় তাদের থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল— হয় তাদের আদর্শ ত্যাগ করতে হবে, নয়তো বাংলা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তারা দ্বিতীয় পথটি বেছে নেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা কোথায় গেলেন? কেন নেপালে গেলেন? এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের নেপালের সেই সময়ের ইতিহাস বুঝতে হবে। তখন নেপালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল এবং নেপালের রাজারা বৌদ্ধ সাধকদের সম্মান করতেন। ফলে বাংলার সহজিয়া সাধকরা নেপালে গিয়ে তাদের ধর্মচর্চা ও সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখেন।
চর্যাপদের কবিরা ছিলেন মূলত এই সহজিয়া সাধক। তাদের মধ্যে কাহ্নপা, লুইপা, ভুসুকুপা, শবরপা, শান্তিপার মতো বিখ্যাত নামগুলো রয়েছেন। তারা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে এসেছিলেন। কেউ ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারের, কেউ রাজপরিবারের, আবার কেউ ছিলেন নিম্নবর্ণের। কিন্তু তারা সবাই মিলেমিশে সাধনা করতেন এবং তাদের রচনায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার ছবি ফুটে উঠেছে।
নেপালে গিয়ে তারা তাদের সাধনা ও সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। তাদের রচিত চর্যাগান, দোহা এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক দর্শন নেপালের বিহার ও রাজদরবারের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত হয়। সেখানে প্রায় হাজার বছর ধরে এই রচনাগুলো অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে থাকে। বাংলার মানুষ এই সম্পদ সম্পর্কে জানতেই পারেনি।
১৮৮২ সালে বাংলার ইতিহাসবিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রথম নেপালে চর্যাপদের অস্তিত্বের সন্ধান পান। কিন্তু তিনি এর সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করতে পারেননি। পরে ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন। ১৯১৬ সালে তিনি এটি "বৌদ্ধ গান ও দোহা" নামে প্রকাশ করেন। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। প্রমাণিত হয় যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা হাজার বছর আগেই শুরু হয়েছিল।
চর্যাপদের ভাষা খুবই জটিল ও রহস্যময়। এতে প্রাকৃত, অপভ্রংশ, সংস্কৃত এবং প্রাচীন বাংলা ভাষার মিশেল দেখা যায়। এই ভাষাকে "সান্ধ্য ভাষা" বলা হয়, কারণ এটি আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সহজিয়া সাধকরা তাদের গুহ্য তত্ত্ব সাধারণ মানুষের কাছে সরাসরি প্রকাশ করতে চাননি, তাই তারা এই জটিল ভাষা ব্যবহার করেছেন।
চর্যাপদে শুধু ধর্মীয় তত্ত্বই নেই, এতে তৎকালীন বাংলার সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রও ফুটে উঠেছে। নদীমাতৃক বাংলার প্রকৃতি, নৌকা বাইচ, মাছ ধরা, কৃষিকাজ, বিবাহ উৎসব, জাতপাতের বিভেদ— এসবের বর্ণনা চর্যাপদের বিভিন্ন পদে পাওয়া যায়। যেমন, ভুসুকুপার একটি পদে লেখা আছে, "আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী। নিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী।" এই পংক্তিতে বাংলার সমাজে জাতপাতের বিভেদের চিত্র ফুটে উঠেছে।
চর্যাপদের কবিরা বাংলা ছেড়ে নেপালে গেলেও তাদের রচনার শিকড় ছিল বাংলার মাটিতে। তাই হাজার বছর পর এই সাহিত্য আবার বাংলায় ফিরে এসেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাত ধরে চর্যাপদ বাংলার সাহিত্যিক সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আজ আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গেলে প্রথমেই চর্যাপদের নাম শুনি। এটি আমাদের গৌরবের বিষয়।
মাৎস্যন্যয়ের অন্ধকার যুগ বাংলার সাহিত্যকে এক নতুন পথে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বাংলার কবিরা নেপালে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের রচনা আজও বাংলা সাহিত্যের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে। চর্যাপদ শুধু একটি গ্রন্থ নয়, এটি বাংলার মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রাচীনতম দলিল। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস কখনও মুছে যায় না, শুধু সময়ের প্রয়োজনে তার রূপ বদলায়।
এম.কে.