ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

হাজী শরীয়ত উল্লাহর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ শরীয়তপুর

বিপ্লব হাসান হৃদয় ,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শরীয়তপুর

প্রকাশিত: ২১:২২, ১১ জুন ২০২৫

হাজী শরীয়ত উল্লাহর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ শরীয়তপুর

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের নদীবিধৌত অঞ্চলের মধ্যে শরীয়তপুর অন্যতম। তবে এ জেলার পরিচয় শুধুই তার নদীভাঙন, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ জেলার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব — হাজী শরীয়ত উল্লাহ।

শরীয়ত উল্লাহর জন্ম ততৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে।

হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৮৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বর্তমানে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃতদেহ জন্মস্থান চর শামাইলে সমাহিত করা হয়। আড়িয়াল খা নদীর ভাঙ্গনের ফলে হাজী শরীয়ত উল্লাহর কবর নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবে বাহদুরপুর মাদ্রাসা-মসজিদ প্রাঙ্গণে পারিবারিক কবরস্থানে পুত্র দুদু মিয়াসহ অন্যান্যদের কবর রয়েছে।

ফরায়েজি আন্দোলনের সূচনা

হাজী শরীয়ত উল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন শরীয়তপুরে। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ১৭৯৯ সালে মক্কা শরীফে যান এবং সেখানে দীর্ঘ ১৯ বছর ধর্মীয় শিক্ষালাভের পর ১৮১৮ সালে বাংলায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসে তিনি আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় শুরু করেন ফরায়েজি আন্দোলন।

প্রথমদিকে ধর্মীয় সংস্কার লক্ষ্য থাকলেও ধীরে ধীরে এই আন্দোলন কৃষক শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন, জমিদারদের অত্যাচার এবং নীলকরদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে হাজী শরীয়ত উল্লাহ তার অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ করেন।

তার মৃত্যুর পর পুত্র দুদু মিয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব নেন। ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের মাঝে নতুন আত্মবিশ্বাস, ধর্মীয় শুদ্ধি ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

ইতিহাসে শরীয়তপুর

স্বাধীনতার পূর্বে এই অঞ্চল ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর হাজী শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জেলার নামকরণ করা হয় 'শরীয়তপুর'। ১৯৮৪ সালে এটি পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এই জেলার আয়তন প্রায় ২৪.৯২ বর্গকিলোমিটার। 

কৃতিসন্তানের জন্মভূমি

শরীয়তপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জন্ম নিয়েছেন দেশবরেণ্য বহু ব্যক্তি, যাঁদের অবদান দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে।

চরআত্রা: খান সাহেব আবদুল আজিজ মুনশি ও শিক্ষাবিদ ড. এ কে এম ফজলুল হক।

নওপাড়া: সাবেক বাণিজ্য সচিব ফিরোজ আহমেদ ও রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ।

পাইকপাড়া: শিক্ষাবিদ আবুল ফারাহ মুহাম্মদ আব্দুল হক ফরিদী ও সাবেক কেবিনেট সচিব আতাউল।

মোক্তারের চর: ভাষা আন্দোলনের ছাত্রনেতা ও সাবেক এমপি ডা. গোলাম মাওলা।

সুরেশ্বর: পীর জান শরীফের মাজার ও ঐতিহ্যবাহী ওরস।

মূলফতগঞ্জ: রাজনীতিক আব্দুল করিম দেওয়ান (মনাই দেওয়ান)।

বাহের দিঘীর পাড়: মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল শওকত আলী।

কলুকাঠি: সাবেক প্রতিমন্ত্রী টি এম গিয়াসউদ্দিন, সিএ সাইদুর রহমান, এ এস জহির মোহাম্মদ, ডা. আলমগীর মতি।

বিলাসপুর: শিক্ষাবিদ আব্দুর রশিদ খলিফা ও ব্যবসায়ী ইউনুস খলিফা।

কবিরাজ কান্দি: প্রাক্তন সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম দানেশ মিয়া।

বড় মুলনা: শিল্পোদ্যোক্তা মোবারক আলী শিকদার।

বড় গোপালপুর: রাজনীতিক মাস্টার মজিবুর রহমান ও মাকসুদুরল হক সিরাজী।

মাঝির ঘাট: ঢাকা-শরীয়তপুর নদীপথের গেটওয়ে।


নদীর দেশ, সংগ্রামের জেলা

পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁসহ অসংখ্য নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা শরীয়তপুর এখনো পদ্মার ভাঙন ও নতুন চরের জন্ম-নিয়মের সাক্ষী। নদীর ক্ষরণ আর সৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে এই জেলা আজও বয়ে চলেছে হাজী শরীয়ত উল্লাহর আদর্শিক উত্তরাধিকার।

Mily

×