
ছবি: সংগৃহীত
ইতিহাস শুধু জয়-পরাজয়ের খতিয়ান নয়, তা মানবতারও দর্পণ। আন্দালুস তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ যেখানে মুসলমানরা এক হাজার বছর ধরে শুধু শাসন করেননি, বরং গড়েছেন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ জ্ঞাননির্ভর সভ্যতা।
বর্তমান স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত আন্দালুস একসময় ছিল ইসলামি সভ্যতার আলোয় আলোকিত এক রাজ্য। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদ ‘জাবাল আল-তারিক’ অতিক্রম করে যাত্রা শুরু করেন, যা আজকের জিব্রাল্টার নামে পরিচিত।তাঁর নেতৃত্বেই শুরু হয় আন্দালুসের ইতিহাস, যা টিকে থাকে প্রায় ৮০০ বছর, ৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে আন্দালুস শুধু রাজনৈতিক শক্তি ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল ইউরোপের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ধর্মীয় সহাবস্থানের কেন্দ্র।
যখন ইউরোপ ছিল অন্ধকার যুগে, তখন "করডোভা" ছিল জ্ঞান-সংস্কৃতির দ্যুতি ছড়ানো নগর।করডোভা শহরে ছিল ৭০টি গ্রন্থাগার,৩৭০টি পাবলিক বাথ এবং লক্ষাধিক আলোকিত রাস্তাঘাট যা লন্ডন বা প্যারিসে ছিল না।সেই নগরে গড়ে উঠেছিল ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্র, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিত একত্রে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন ছিলেন।আন্দালুসের জ্ঞানচর্চা শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, ইউরোপের রেনেসাঁতেও গূঢ় প্রভাব ফেলে।উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ ও বৈজ্ঞানিক:
ইবনে রুশদ : অ্যারিস্টটল ব্যাখ্যার মাধ্যমে পাশ্চাত্য দর্শনে বিপ্লব ঘটান।
আল-জাহরাভি: আধুনিক সার্জারির জনক; ৩০০+ অস্ত্রোপচারের যন্ত্র আবিষ্কার।
ইবনে তোফায়েল: ‘হায় ইবনে ইয়াকজান’ উপন্যাসে আত্ম-উপলব্ধি ও দার্শনিক রূপকতা।
ইবনে হাযম: প্রেম ও আত্মার অন্বেষণে ‘তাওক আল-হামামা’ রচনা।
আন্দালুসে বিজ্ঞান ছিল ধর্মের বিরোধিতা নয়, বরং ধর্মীয় দায়বদ্ধতার অংশ।জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যঘড়ি, মানমন্দির, ও দিকনির্দেশক যন্ত্র উদ্ভাবন করেন।রসায়নে মিশ্রণ, পাতন, ও অ্যালকোহলের ধারণা এইখান থেকেই ইউরোপে প্রবেশ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনার ‘আল-কানুন’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপে পাঠ্যবই ছিল।আন্দালুস ছিল এমন একটি সমাজ, যেখানে মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টান একত্রে বসবাস করতেন।সবাই শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় অংশ নিতেন।ধর্মীয় বিভেদ নয়, মানবতা ও জ্ঞানের বন্ধনই ছিল মুখ্য।এই সহাবস্থানই ছিল আন্দালুস সভ্যতার সবচেয়ে বড় শক্তি, যা আজকের ধর্মীয় সহিংসতায় আক্রান্ত বিশ্বে এক অনন্য আদর্শ।আজও স্পেনের আল-হামরা প্রাসাদ, গ্রানাডার মসজিদ, করডোভার মসজিদ প্রমাণ করে দেয় মুসলিম স্থাপত্যশিল্প কতটা সূক্ষ্ম, নান্দনিক ও চিন্তাশীল ছিল।আন্দালুসীয় স্থাপত্যে চোখে পড়ে:জ্যামিতিক কারুকাজ,আরবি ক্যালিগ্রাফি,জ্যোতির্বিদ্যামূলক অলংকরণ।যা কেবল দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের এক অপূর্ব সম্মিলন।
পতন ও বেদনার অধ্যায় -
১৪৯২ সালে গ্রানাডা পতনের মাধ্যমে শেষ হয় আন্দালুসের ইসলামি শাসন। এরপর শুরু হয় "রেকনকুইস্তা" মুসলমানদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও নির্বাসনের নির্মম ইতিহাস।শত শত মসজিদ রূপান্তরিত হয় গির্জায়। ধ্বংস হয় গ্রন্থাগার, পুড়িয়ে ফেলা হয় শত শত পাণ্ডুলিপি। কিন্তু সভ্যতা ধ্বংস করা যায় না তার প্রভাব থেকে যায়।
আন্দালুস কেবল একটি হারানো রাজ্য নয় এটি আমাদের জন্য এক পাঠশালা।এই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় “যেখানে জ্ঞান, সহনশীলতা ও ন্যায়ের রাজত্ব হয়, সেখানেই সভ্যতা জন্ম নেয়। ধর্ম শুধু একা নয়, বরং মানবতার সঙ্গে চললেই তা মহৎ হয়।” আজকের বিভক্ত বিশ্বে আন্দালুস আমাদের শেখায় সহাবস্থান সম্ভব, যদি ইচ্ছা থাকে উন্নয়ন সম্ভব, যদি জ্ঞানকে প্রধান অস্ত্র করা হয়।
Mily