
ছবি: প্রতীকী
জাতিসংঘের ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫’ প্রতিবেদন বলছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ এবং উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাবের কারণে কমে যাচ্ছে বৈশ্বিক জন্মহার।
বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ তাদের প্রত্যাশিত সংখ্যক সন্তান নিতে পারছেন না। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA)-এর নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সন্তান না হওয়ার প্রধান কারণ বন্ধ্যাত্ব নয়, বরং আর্থিক সীমাবদ্ধতা, মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড পপুলেশন ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে পরিবার গঠনের স্বাধীনতা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। এর জন্য দায়ী উচ্চ জীবনযাপন ব্যয়, যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং উপযুক্ত সঙ্গীর অভাব। প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেকেই সন্তান নিতে চান, কিন্তু অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা তাদের সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দিচ্ছে না।
এই গবেষণাটি UNFPA এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান YouGov যৌথভাবে পরিচালনা করেছে। অনলাইন জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন—সন্তান নেওয়ার পথে প্রধান বাধা হলো খরচ, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং বাসস্থানের উচ্চমূল্য। এই তথ্য থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, জন্মহার কমার পেছনে মানুষের ইচ্ছার ঘাটতি নয়, বরং বাস্তবিক প্রতিবন্ধকতা কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বের অর্ধেকের বেশি দেশে নারীদের গড় জন্মহার ২.১-এর নিচে নেমে এসেছে। অথচ এটি হচ্ছে জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় জন্মহার, যেখানে অভিবাসনের প্রভাব বিবেচনায় আনা হয়নি। অন্যদিকে, প্রায় সব অঞ্চলেই মানুষের গড় আয়ু বেড়ে চলেছে।
জাতিসংঘের এই জরিপে ১৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেখানে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বসবাস। দক্ষিণ কোরিয়া, যেটি বিশ্বের সবচেয়ে কম জন্মহারের দেশ, সেই তালিকায় ছিল। আবার নাইজেরিয়া, যেটি উচ্চ জন্মহারের জন্য পরিচিত, সেটিও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ছিল ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, জার্মানি, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালি, মরক্কো, সুইডেন এবং হাঙ্গেরি।
সন্তান নেওয়ার পথে প্রধান বাধা অর্থনৈতিক উদ্বেগ
১৪,০০০-এরও বেশি মানুষের ওপর পরিচালিত একটি অনলাইন জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার ব্যক্তিগত পরিস্থিতিতে, কোন কোন কারণ আপনাকে আপনার প্রত্যাশার তুলনায় কম সন্তান নিতে বাধ্য করেছে বা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?’
নিম্নে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলো উপস্থাপন করা হলো-
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, যারা সন্তান নেওয়া থেকে বিরত থাকছেন, তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ বলেছেন—চাকরি ও আয়ের স্থায়িত্বহীনতা তাদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। ১৯ শতাংশ জানিয়েছেন—জলবায়ু পরিবর্তন ও যুদ্ধের মতো ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাদের সন্তান না নেওয়ার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি, নারীদের মধ্যে ১৩ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ৮ শতাংশ স্বীকার করেছেন যে, ঘরের কাজে অসম দায়িত্ববণ্টনও সন্তান না নেওয়ার একটি বড় কারণ।
তবে কেবল ১২ শতাংশ মানুষ বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভধারণে সমস্যা থাকার কথা বলেছেন। এই হার কিছু দেশে বেশি—যেমন থাইল্যান্ডে ১৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ শতাংশ।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের নির্বাহী পরিচালক নাটালিয়া কানেম বলেছেন, ‘জন্মহার কমে যাচ্ছে কারণ মানুষ মনে করে তারা সেই পরিবার গড়ার সুযোগ পাচ্ছে না, যা তারা চায়।’ তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদনটি প্রমাণ করে যে, বৈশ্বিকভাবে আমরা কোনো জন্মহারের সংকটের মুখে পড়িনি, বরং আমরা পড়েছি প্রজনন অধিকার হরণের সংকটে।’
দক্ষিণ কোরিয়ায় তিনজনের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, তাদের সন্তান না নেওয়ার প্রধান কারণ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। অথচ সুইডেনে এই হার মাত্র ১৯ শতাংশ, যেখানে প্রত্যেক পিতামাতাকে ৪৮০ দিন পর্যন্ত বেতনসহ মাতৃত্ব বা পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়, এমনকি তা দাদাদাদিরাও নিতে পারেন। তবু, সেই দেশেও জন্মহার বিশ্বের অন্যতম নিচের কাতারে রয়ে গেছে।
জাতিসংঘ বলছে, একক কোনো কারণকে দায়ী করে ফল পাওয়া যাবে না। এটি একটি জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার ফল। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের সামাজিক পরিসংখ্যান ও জনসংখ্যা বিশ্লেষণের অধ্যাপক আরকাডিউস উইসনিওভস্কি বলেন, ‘সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত শুধু অর্থের বিষয় নয়, এর সঙ্গে সময়, শিশুসেবা, চাকরির নিরাপত্তা এবং পরিবার ব্যবস্থাও জড়িত।’
জাতিসংঘ বলছে, যারা সন্তান নিতে পারছে না, তাদের জন্য যথার্থ সমাধান হতে পারে ‘প্রজনন অধিকার’ নিশ্চিত করা—মানে ব্যক্তি যেন নিজের সিদ্ধান্তে, স্বাধীনভাবে, সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে ঠিক করতে পারেন—তিনি সন্তান নেবেন কি না, কখন নেবেন এবং কাদের সঙ্গে গড়বেন পরিবার।
মানুষ আসলে কত সন্তান চান?
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) ও ইউগভ (YouGov) পরিচালিত এই অনলাইন জরিপে ১৪টি দেশের ১৪,০০০-এরও বেশি নারী ও পুরুষকে একটি সরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করা হয়েছিল—‘আপনার মতে আদর্শভাবে আপনার কয়টি সন্তান থাকা উচিত?’
এই প্রশ্নের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বর্তমান বিশ্বের মানুষের সন্তান নেওয়ার প্রবণতা কমে যাওয়ার পেছনে আদৌ ইচ্ছার অভাব রয়েছে কি না, নাকি পরিস্থিতির বাধা মানুষকে সন্তান নেওয়া থেকে বিরত রাখছে।
নিম্নে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলো উপস্থাপন করা হলো-
কিছু দেশ জন্মহারে গতি আনতে ‘বেবি বোনাস’, অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং সন্তানের লক্ষ্য নির্ধারণ করছে। তবে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, এসব কার্যক্রম অনেক সময় ফলপ্রসূ না হয়ে বরং ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে।
নাটালিয়া কানেম বলেন, ‘যখন মানুষ দেখে রাষ্ট্র বা সমাজ তাদের সন্তান নেওয়ার বিষয়ে চাপ দিচ্ছে, তখন তারা আরও বেশি পিছিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, সন্তান নিতে উৎসাহ দিতে হলে প্রথমে সেই বাধাগুলো সরাতে হবে, যেগুলো মানুষ নিজেই চিহ্নিত করছে—যেমন বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, কাজের নিরাপত্তা এবং পারিবারিক ছুটির সুযোগ।
শেষ পর্যন্ত, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারগুলোর উচিত একটি দীর্ঘমেয়াদি, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত নীতি গ্রহণ করা। জন্মহার বাড়ানো কোনো সহজ কাজ নয়। বরং এটি একটি সংবেদনশীল সামাজিক ইস্যু, যা সময় ও সহানুভূতিশীল নীতির দাবি রাখে।
সূত্র: আল জাজিরা।
রাকিব