ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমা’: জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইসলামী স্বর্ণযুগ

টি এম মারুফ জামান মাহী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী 

প্রকাশিত: ১৫:৪০, ১১ জুন ২০২৫

বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমা’: জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইসলামী স্বর্ণযুগ

ছবি: সংগৃহীত

৮ম শতকের গোড়ায় খলিফা হারুন আল রশিদ যখন বাগদাদকে ইসলামী সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন, তখন এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, শিগগিরই হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর পুত্র খলিফা আল-মামুন ৮১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বায়তুল হিকমা’ House of Wisdom। এটি শুধু একটি গ্রন্থাগার নয়, বরং ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন, গণিত, অনুবাদ ও প্রযুক্তির এক অভূতপূর্ব গবেষণা কেন্দ্র। বায়তুল হিকমায় কাজ করতেন মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ও জোরোঅস্ট্রিয়ান পণ্ডিতরা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-

হুনাইন ইবনে ইসহাক (খ্রিস্টান): গ্রীক চিকিৎসাশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক।

থাবিত ইবনে কুরা (সাবিয়্যান): গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে অগ্রগামী।

ইবনে মাসাওয়াইহ: চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোরোগ গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান।

এই সহাবস্থান প্রমাণ করে ইসলামি সভ্যতা তখন ধর্মকে একমাত্র পরিচয় নয়, বরং জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।

জ্ঞানবিপ্লবের এক বড় দিক ছিল গণিতে। মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি ছিলেন বায়তুল হিকমার উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি আধুনিক অ্যালজেবরা (al-jabr) ও অ্যালগরিদম (algorithm) ধারণার ভিত্তি গড়ে দেন। হিন্দু-আরবি সংখ্যা পদ্ধতি (০–৯) ও শূন্যের ব্যবহারকে জনপ্রিয় করে তোলেন। “কিতাব আল-জাবর ওয়াল মুকাবালাহ” রচনা করেন, যা ইউরোপে শতাব্দীর পর শতাব্দী গণিতের মূলপাঠ্য ছিল।আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞান তাঁর কাজেরই আধুনিক রূপ।

বায়তুল হিকমার সবচেয়ে ফলপ্রসূ শাখাগুলোর একটি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান

আল রাজি (Rhazes):“আল হাওয়ি” (Liber Continens) রচনা করেন, যেটি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭শ শতক পর্যন্ত পাঠ্য ছিল। তিনি গুটি বসন্ত ও হাম রোগের পার্থক্য প্রথম ব্যাখ্যা করেন।

ইবনে সিনা (Avicenna): “আল-কানুন ফি আল-তিব্ব” বা “Canon of Medicine” গ্রন্থটি ইউরোপে ৫০০ বছর চিকিৎসা শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।তিনি মানবদেহ, স্নায়ুতন্ত্র ও সংক্রামক রোগ নিয়ে বিশ্লেষণমূলক গবেষণা চালান।

বায়তুল হিকমা গ্রীক দর্শনকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার এক অনন্য ক্ষেত্র তৈরি করে।

আল-ফারাবি: প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের চিন্তার ভিত্তিতে ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের কাঠামো নির্মাণ করেন।
প্রথম দর্শন ও যুক্তির সমন্বয়ে সমাজ কাঠামোর রূপরেখা দেন।

ইবনে রুশদ (Averroes): অ্যারিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার হিসেবে পশ্চিমে খ্যাত।ইউরোপীয় স্কলাস্টিক দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি তৈরি করেন।

এই দার্শনিকরা প্রমাণ করেন ইসলাম শুধুই বিশ্বাস নয়, বরং যুক্তি ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও এক পরিপূর্ণ জগৎ।

বায়তুল হিকমার অন্যতম প্রধান অবদান ছিল অনুবাদ আন্দোলন।খলিফা আল-মামুন মিশর, সিরিয়া, ভারত ও বাইজান্টাইন থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে আরবিতে অনুবাদের জন্য অর্থ ব্যয় করেন।

গ্রীক দার্শনিক: অ্যারিস্টটল, প্লেটো, হিপোক্রেটিস।
ভারতীয় জ্যোতির্বিদ: আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত।
পারস্যের সাহিত্য: শাহনামা, জেন্দ-আবেস্তা।

এই অনুবাদের ফলে এক বহুভাষিক, বহু-জ্ঞানশাখার মিলনমঞ্চ গড়ে ওঠে, যা ইউরোপের রেনেসাঁ-রও পূর্বসূরী হয়ে ওঠে। বায়তুল হিকমা কেবল জ্ঞান সংরক্ষণ করত না, বরং জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের জন্য মানমন্দির স্থাপন।
-ঔষধ তৈরির পরীক্ষাগার
-মানচিত্র অঙ্কন ও ভূগোলচর্চা
-রাসায়নিক গবেষণা
-হাইড্রোলিক ও যান্ত্রিক প্রকৌশল গবেষণা

প্রকৃতপক্ষে, বায়তুল হিকমা ছিল আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রূপ যেখানে তত্ত্ব, গবেষণা ও প্রয়োগ মিলিত হতো।

ধ্বংসের ইতিহাস: মঙ্গোল আগ্রাসন ও কালির নদী

১২৫৮ সালে মঙ্গোল নেতা হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন। বহু মাস ধরে চলা লুটপাট ও ধ্বংসে বায়তুল হিকমার সমস্ত গ্রন্থ, মানচিত্র ও গবেষণা দলিল তিগ্রিস নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী- “তিগ্রিস নদীর পানি বইয়ের কালি ও চর্মচ্ছদে এতটাই কালো হয়ে গিয়েছিল যে, কয়েক দিন ধরে সূর্যের আলো পড়েনি।”

এই ধ্বংস ছিল শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান নয় একটি যুগ, একটি চিন্তাধারা ও এক সমগ্র সভ্যতার পতন।

বায়তুল হিকমা আমাদের শিখায় ধর্ম ও জ্ঞান পরস্পর বিরোধী নয়। সহাবস্থান, বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যেই নিহিত প্রকৃত প্রজ্ঞা। ইসলামের প্রকৃত ঐতিহ্য কখনো কূপমণ্ডূকতা নয়, বরং মুক্তবুদ্ধি ও বিশ্লেষণ। বায়তুল হিকমা ছিল একটি জ্ঞাননির্ভর সাম্যবাদী সভ্যতার প্রতিচ্ছবি যেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানুষ গবেষণায় যুক্ত হত। আজকের মুসলিম সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি সেই মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ ঘটে তবে আমরা কেবল অতীতের গৌরবই নয়, ভবিষ্যতের নেতৃত্বও ফিরে পেতে পারি।

জ্ঞানই যদি হয় উত্তরাধিকার, তবে তা ফিরিয়ে আনাই আমাদের দায়িত্ব। আজকের প্রজন্ম যখন প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে নতুন দিগন্তের সন্ধানে, তখন বায়তুল হিকমা আমাদের ইতিহাস নয়, প্রেরণার উৎস।

আবির

×