ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভৈরবের অদম্য মাঝি: ৩৮ বছরেও থামেনি বৈঠার টান

তানিম মল্লিক,কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০০:২২, ২১ মে ২০২৫

ভৈরবের অদম্য মাঝি: ৩৮ বছরেও থামেনি বৈঠার টান

ছবি: সংগৃহীত

‘বউ, তিনটা ছেলে, আর মা মরা মেয়েটার রেখে যাওয়া নাতি,সবাই তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি যদি দাঁড় না টানি, নৌকা না চালাই, সংসার চলবে কী করে?’-এমন সহজ অথচ হৃদয়ভরা কথায় নিজের গল্প শুরু করলেন মোহাম্মদ আবুল কালাম শেখ।নদী যেন তার জীবন, বৈঠা যেন তার শ্বাস। প্রতিদিন সূর্যের আলোয় শুরু হয় তার নতুন লড়াই,পরিবারের মুখে আহার তুলে দেওয়ার লড়াই, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। 

প্রতিদিন নদীর বুকে সূর্য ওঠে, আবার রাতের আঁধারে মিলিয়ে যায় দিগন্ত। সেই আলো-আঁধারির খেলা যেন প্রতিনিয়ত নতুন করে লিখে জীবনসংগ্রামের গল্প। এমনই এক গল্পের নায়ক মোহাম্মদ আবুল কালাম শেখ যিনি খুলনার রূপসা উপজেলার চর মুসাব্বাতপুরের নিবেদিতপ্রাণ এক মাঝি। ৩৮ বছর ধরে ভৈরব নদে বৈঠা হাতে শুধু নৌকা চালান না, সাথে এগিয়ে নেন জীবনের পথচলাও।

১৯৮৮ সাল থেকে বৈঠা হাতে ভৈরব নদীর বুকে ছুটে চলা আবুল কালামের রক্তে যেন মিশে আছে এই পেশা।তিনি জানান, তার বাবা এবং বড় ভাইও ছিলেন মাঝি। বংশ পরম্পরায় পাওয়া এই পেশাটিকেই তিনি আঁকড়ে ধরেছেন জীবনের প্রয়োজনে। অন্যান্য কাজ তাকে কখনো টানেনি।

রোদ, ঝড়, বৃষ্টি প্রকৃতির কোনো প্রতিকূলতাই থামাতে পারেনি তাকে। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি ১২-১৩ ঘণ্টা নিরলস পরিশ্রম করেন। দৈনিক ইনকাম ৫০০ অথবা ৮০০ টাকা । সেই পরিশ্রমেই জ্বলে তার পরিবারের চুলা, সন্তানরা পায় স্কুলে যাওয়ার সুযোগ। এই একটানা সংগ্রাম যেনো এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত।

জীবনের পথচলায় এসেছে নানা বিপর্যয়। নৌকা ডুবে যাওয়া, যাত্রীদের অবজ্ঞা, সমাজের অবহেলা স্বত্বেও দমে যাননি কালাম মাঝি। বরং আরও দৃঢ়ভাবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মুখে উচ্চারিত একটি বাক্য যেন তার চরিত্রেরই সারাংশ, ‘কোনো পেশাই ছোট নয়।’এই কথার মাধ্যমে তিনি যেমন নিজেকে সম্মান দেন, তেমনি সমাজকে মনে করিয়ে দেন, সম্মান পাওয়ার অধিকার সবার আছে।

তবে এত কষ্টের পরও ভাগ্যের পাতায় নেই কোনো সহায়তার ছাপ। আবুল কালাম শেখ জানান, কোনোদিনও সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যের মুখ দেখেননি। এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে বহুবার গিয়েছেন—কিন্তু ফিরেছেন খালি হাতে। যেন নদীর মাঝেই ফেলে রাখা হয়েছে তাঁদের প্রাপ্য অধিকারগুলো, যা আর তীরে এসে পৌঁছায় না।

তার সহকর্মী মোহাম্মদ ইলিয়াস শেখ বলেন, ‘এই পেশা সম্মানের, তবু মাঝিদের জীবন অবহেলায় ভরা।’তিনি জানান, বছরের পর বছর নদীতে কাটিয়ে দেওয়ার পরও মাঝিদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছু নেই। অর্থাভাবে অনেক সময় সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তাদের কাছে নৌকা চালানো শুধু একটি পেশা নয়, এ এক জীবনভর লড়াই।

তবুও তারা থেমে যান না। মুখে কোনো অভিযোগ নেই, কষ্টের কথা চেপে রেখে প্রতিদিন চালিয়ে যান নৌকা। সেই নৌকার সঙ্গে বহন করেন জীবনের ভারও। এই সহ্যশক্তি ও আত্মত্যাগই প্রমাণ করে মাঝির জীবনও হতে পারে মহৎ ও গৌরবময়।

মাঝিদের দলনেতা বাদল মোল্লার চোখে আবুল কালাম শেখ একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি বলেন, ‘আবুল কালাম খুব পরিশ্রমী। আগে যেমন সৎ ও শান্ত স্বভাবের ছিল, এখনও তেমনই আছে। তবে এখন তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। নদীর ঢেউ দেখেই তিনি দিনের পূর্বাভাস দিতে পারেন। নতুন মাঝিদের তিনি সাহায্য করেন। আমি তাকে কখনো কারো সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। অনেক কষ্টেও তিনি ভেঙে পড়েন না। তিনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। নদীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আবুল কালামের কাজের প্রতি আন্তরিকতা আজও আগের মতোই আছে।’

আরমান

×