ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৭ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বায়োচার: জলবায়ু সুরক্ষা এবং কৃষি উন্নয়নে টেকসই সমাধান

অর্ঘ্য প্রতীক চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বিইউপি

প্রকাশিত: ১৫:৪৫, ৬ জুন ২০২৫

বায়োচার: জলবায়ু সুরক্ষা এবং কৃষি উন্নয়নে টেকসই সমাধান

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু আজ আমাদের কৃষক যুদ্ধ করছে একাধিক সমস্যার বিরুদ্ধে। উর্বর মাটি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে, রাসায়নিক সারের দাম আকাশছোঁয়া আবার তা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকরও বটে, আর জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে ফসল ফলানো ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, কার্বন দূষণ বেড়েই চলেছে, যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, বিরূপ আবহাওয়ার ঘটনা ঘটছে ঘনঘন। এই জটিল সমস্যাগুলোর সমাধানে বিজ্ঞানীরা ফিরে যাচ্ছেন এক প্রাচীন পদ্ধতির দিকে,  যার নাম “বায়োচার”। এটি এক ধরণের বিশেষ কৃষিজ - অঙ্গার (চারকোল) , যা মাটিতে কার্বন আটকে রাখতে পারে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে পারে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বায়োচার কী?

বায়োচার এক ধরনের বিশেষ চারকোল, যা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে (বা অল্প অক্সিজেনে) উচ্চ তাপমাত্রায় কৃষি-বর্জ্য (ধান বা গমের খড়, কাঠের টুকরা, গোবর ইত্যাদি) পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পাইরোলাইসিস। সাধারণ ছাই বা পুরোপুরি পোড়া কয়লার মতো নয়, বায়োচার অত্যন্ত স্থিতিশীল এবং সহজে পচে না। মাটিতে মিশিয়ে দিলে এটি শতাব্দী থেকে সহস্রাব্দকাল ধরে কার্বনকে মাটির নিচে আটকে রাখে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে “কার্বন সিকোয়েস্ট্রেশন” বা কার্বন মজুদকরণ। এটি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) টেনে এনে নিরাপদে মাটিতে জমা করার একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি।

কার্বন মজুদের গুরুত্ব কেন?
বায়োচার কীভাবে কার্বন শোষণ করে?

কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂) হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী প্রধান গ্যাস । গাছপালা বেড়ে ওঠার সময় বায়ুমণ্ডল থেকে CO₂ শোষণ করে কার্বনকে তাদের দেহে জমা করে (জৈব ভর তৈরি করে)। কিন্তু যখন এই গাছপালা বা কৃষি-বর্জ্য স্বাভাবিকভাবে পচে বা পুড়ে যায়, তখন সেই সংরক্ষিত কার্বন দ্রুত CO₂ আকারে বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে। এখানেই বায়োচারের যাদুকরী ভূমিকা। পাইরোলাইসিস প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের অভাবে উচ্চ তাপ দেওয়ার ফলে জৈব পদার্থের কার্বন একটি অত্যন্ত স্থায়ী, জৈব-রাসায়নিকভাবে “অক্রিয়” কাঠামোতে (সাধারণত অ্যারোমাটিক কার্বন রিং) রূপান্তরিত হয়। এই বিশেষ কাঠামো মাটির অনুজীবদের পক্ষেও সহজে ভাঙা বা পচানো সম্ভব হয় না। ফলে, বায়োচার হিসেবে মাটিতে মিশিয়ে দিলে, প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাওয়ার কথা থাকা সেই কার্বন শতাব্দীর পর শতাব্দী মাটির গভীরে আটকে থাকে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, ১ টন বায়োচার বায়ুমণ্ডল থেকে প্রায় ৩ টন CO₂-এর সমতুল্য কার্বন স্থায়ীভাবে সরাতে সক্ষম। ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা গেলে, প্যারিস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বায়োচার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

বায়োচারের পরিবেশগত সুবিধার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি:

বায়োচার পরিবেশকে রক্ষা করে তিনটি শক্তিশালী উপায়ে:

১.  দীর্ঘমেয়াদী কার্বন সংরক্ষণ: বায়োচারের ৫০–৭০% হল খাঁটি কার্বন। মাটিতে মিশে গেলে এটি শত শত বছর অপরিবর্তিত থাকে, ফলে সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে CO₂ হিসেবে মিশতে পারে না। 

২.  অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস: মাটিতে থাকা অনুজীবগুলো মিথেন (CH₄) ও নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O) নামের দুটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করে, যাদের তাপ ধারণ ক্ষমতা CO₂ এর চেয়েও বহুগুণ বেশি। বায়োচার মাটির রাসায়নিক গঠন ও আর্দ্রতার মাত্রা পরিবর্তন করে এই গ্যাসগুলোর উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

৩.  সার ব্যবহার কমাতে সাহায্য:  বায়োচার মাটির পুষ্প উপাদান ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়, ফলে সিন্থেটিক সারের প্রয়োজনীয়তা কমে। এসব সার উৎপাদন ও ব্যবহারের সময় বিপুল পরিমাণ N₂O গ্যাস নির্গত হয়। মনে রাখা দরকার, নাইট্রাস অক্সাইডের তাপ ধারণ ক্ষমতা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ২৯৮ গুণ বেশি । বায়োচার ব্যবহার করে চাষের জমি থেকে এই গ্যাসের নিঃসরণ ৫০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব ।

বাংলাদেশের জন্য বায়োচার কেন উপকারী?

বাংলাদেশ একইসাথে মাটির অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বায়োচার এই দুটো সমস্যারই একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনে: বায়োচার মাটির গঠন উন্নত করে, অনুজীবের কার্যকলাপ বাড়ায় এবং পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে – যা খরা বা বন্যার সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ধান, ভুট্টা ও শাকসবজি ক্ষেতে বায়োচার প্রয়োগের পরীক্ষায় (বিশেষ করে কম্পোস্ট বা গোবরের সাথে মিশিয়ে) ফলন ১০–২৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

পানি দূষণ রোধ করে: বায়োচার অতিরিক্ত সার শুষে নেয় এবং তা নদী-খালে মিশে যাওয়া রোধ করে। এটি ইউট্রোফিকেশন নামক সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। 

কৃষি-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: কৃষকেরা প্রায়ই ফসলের পরিত্যক্ত অংশ (খড়, কুড়া ইত্যাদি) পুড়িয়ে ফেলেন, যার ফলে ধোঁয়া ও CO₂ নির্গত হয়। সেই বর্জ্যকে বায়োচারে রূপান্তরিত করলে দূষণ বন্ধ হয় এবং এর পরিবর্তে একটি মূল্যবান সম্পদ পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: বৈশ্বিক কার্বন বাজারের নিয়ম অনুযায়ী বায়োচার প্রকল্পগুলোর সার্টিফিকেশন পেলে, কৃষকেরা মাটিতে কার্বন জমা রাখার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা (কার্বন ক্রেডিট) পেতে পারেন।

বাংলাদেশে গবেষণা ও উদ্ভাবন

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নিরলস প্রচেষ্টায় দেশটি বায়োচার গবেষণা ও উদ্ভাবনে আঞ্চলিক নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), এবং মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালসহ বিভিন্ন কৃষি-বাস্তু অঞ্চলের মাটি ও ফসলে বায়োচারের কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত ও প্রায়শই বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত নানা ধরনের জৈব উপাদান (বায়োমাস) নিয়ে পরীক্ষা করছেন – যেমন ধানের তুষ, পাটকাঠি, আখের ছোবরা, নারকেলের খোসা, গোবর, এমনকি পোলট্রি লিটার। প্রতিটি উপাদান থেকে তৈরি বায়োচারের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ, পাটকাঠির বায়োচারে পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি, আর ধানের তুষের বায়োচারে সিলিকা বেশি থাকে, যা মাটির বায়ু চলাচল ও পোকামাকড় প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর।

গবেষণাগারের বাইরেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বায়োচার প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে আগ্রহ বাড়ছে। স্থানীয় উদ্ভাবক ও এনজিওগুলো সহজলভ্য ও বহনযোগ্য পাইরোলাইসিস চুল্লি তৈরি করছেন, যেমন ড্রাম কিল্ন বা টপ-লিট আপড্রাফ্ট (টিএলইউডি) স্টোভ। এগুলো বিদ্যুৎ বা জটিল যন্ত্রপাতি ছাড়াই ছোট খামারে ব্যবহার করা যায়। কিছু সংস্থা রিকশা ভ্যান বা ছোট ট্রেলারে বসানো মোবাইল বায়োচার উৎপাদন ইউনিট পরীক্ষা করছে, যা উৎপাদনকারীদেরকে খামার থেকে খামারে নিয়ে গিয়ে সরাসরি মাঠেই কৃষি-বর্জ্যকে বায়োচারে রূপান্তর করতে দেয়।

এই উদ্ভাবনগুলি বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করে সার্কুলার ইকোনমি চর্চাকে উৎসাহিত করে এবং সরকারের জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি (ক্লাইমেট-স্মার্ট এগ্রিকালচার) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করে। বায়োচার প্রকল্পগুলো জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) এর আওতায় জলবায়ু প্রশমন কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে এবং কার্বন ক্রেডিট প্রোগ্রামে তাদের সম্ভাবনার জন্য মনোযোগ পাচ্ছে।

বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ পথ

সমগ্র বাংলাদেশে বায়োচারকে একটি কার্যকর ও জলবায়ু-সহিষ্ণু কৃষি সমাধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রয়োজন:

1.  নীতিগত সমর্থন:বায়োচারকে জাতীয় জলবায়ু নীতিতে (জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা, এনডিসি) অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কেননা এটি বায়ুমণ্ডলের কার্বন কমাতে এবং মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম।

2.  কৃষক প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণ:ওয়ার্কশপ ও মাঠ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে কৃষকদের বায়োচার তৈরির সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবহার শেখাতে হবে। যুব সমাজকে বায়োচার ভিত্তিক ছোট সবুজ উদ্যোগ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে হবে।

3.  স্থানীয় উৎপাদন কেন্দ্র: গ্রামীণ পর্যায়ে ছোট ছোট স্থানীয় কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে, যারা আশেপাশের খামার থেকে কৃষি-বর্জ্য সংগ্রহ করে তা বায়োচারে রূপান্তরিত করে স্থানীয় কৃষকদের সরবরাহ করবে।

4.  অর্থায়নের সন্ধান: এই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্বন মার্কেট (ভিসিএম) এর মতো বৈশ্বিক তহবিলের জন্য আবেদন করতে পারে। এগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিনিময়ে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে।

5.  নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা: বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মাটি, ফসল ও জলবায়ু পরিস্থিতিতে বায়োচারের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে সর্বোত্তম ফলাফল নিশ্চিত করা যায়।

বায়োচার নতুন কোন আবিষ্কার নয়। প্রায় ২,০০০ বছর আগে আমাজনের আদিবাসীরা বনজ বর্জ্য ব্যবহার করে "টেরা প্রেটা" বা কালো মাটি তৈরি করতেন – যা আজও উর্বর। এখন, এই প্রাচীন কৌশলই বাংলাদেশের জন্য কার্বন দূষণ কমানো, মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কৃষিকে আরো সহনশীল করে তোলার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। বায়োচার কেবল একটি কৃষি উপকরণ নয়, এটি আমাদের পায়ের নিচে চাপা পড়ে থাকা একটি সম্ভাবনাময় জলবায়ু সমাধান যা আমাদের মাটিকে করে তুলতে পারে ভবিষ্যতের জন্য আরও সবুজ, আরও উর্বর।

সাব্বির

×