শিল্পীদের অভিমত
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের চেহারাও। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল বিটিভি-বেতার ও শিল্পকলাতে শুরু হয় আধিপত্য বিস্তার। একটি পক্ষ আসে অন্য পক্ষ আড়ালে চলে যায়। সহজ কথায়-কেউ সারা বছর ধরে অনুষ্ঠান করে, আবার কাউকে কখনো দেখা যায় না। তাদের অনেকেরই দাবি, দেশীয় জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমগুলো নির্দিষ্ট কিছু শিল্পীকে বছরের পর বছর পারফর্ম করতে দেয় না।
তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছে এক অদৃশ্য কালো তালিকা; যা তৈরি করা হয়েছে মূলত শিল্পীদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে; যা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বহির্ভূত একটি কাজ। এমন কালো তালিকায় আছেন দেশের জনপ্রিয় অনেক শিল্পী। উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন- কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর, মনির খান, বেবী নাজনীন, কনকচাপা, ডলি সায়ন্তনী, সোহেল মেহেদি, মুহিন খানসহ আরও অনেকে। আবার কালো তালিকার বাইরে কেউ কেউ ব্যক্তিগত লেয়াজুবৃত্তি করতে না পারায় সুযোগ পাননি।
এ কালো তালিকায় শুধু শিল্পীরাই নন, অনেক গীতিকার, সুরকার ও সংগীতপরিচালক আছেন বলেও কেউ কেউ জানান। দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবার যে পরিবর্তন এসেছে তার সঙ্গে শিল্পীরাও সংস্কৃতি অঙ্গনগুলোতে সংস্কারের দাবি তুলেছেন। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল বিটিভি-বেতার ও শিল্পকলাকে রাজনীতিমুক্ত দেখার প্রত্যাশা করছেন তারা। গেল কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে অনেকেই তাদের মত প্রকাশ করছেন।
জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা বলেন, ‘কালো তালিকা কোনো শিল্পীর জন্য কাম্য না। এটি করা কখনোই উচিত না। কিন্তু আমাদের বারবার এটি দেখতে হচ্ছে। একজন শিল্পী যে কোনো একটি দলকে সমর্থন করতেই পারেন। এটি তার নাগরিক অধিকার। কিন্তু তার জন্য তাকে কালো তালিকাবদ্ধ করতে হবে এটি ঠিক না। ২০১৮ সাল থেকে আমি বিটিভি ও রেডিও বেতার থেকে শুরু করে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতেও গান করার সুযোগ পাইনি। আমাদের দেশে এখন অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল আছে। এত চ্যানেলে মধ্যে দেশ টিভি ও এটিএন চ্যানেল ছাড়া কোথাও গান করতে পারিনি।’
দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মনির খানও গত সরকারের আমলে বিটিভি, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন স্থানে কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজন সংগীতকর্মী। তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। তারপরও দীর্ঘ ১৬ বছরে বিটিভি, রেডিও ও শিল্পকলায় গান গাওয়ার সুযোগ পাইনি। আরও কষ্টের বিষয় হলো, যাদের সঙ্গে গান করেছি, সংগীত পরিবারের অনেকেও আমাদের মধ্যে দেওয়াল তুলে দিয়েছিলেন।
যেন সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে যেতে না পারি। এমন অসভ্যপনা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আশা করা যায় না। আগামীতে এসব আর দেখতে চাই না। সব শিল্পী যেন তাদের যোগ্য সম্মান পায় সেটাই আশা করি। সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী বলেন, আমি কোনোদিন কোনো সরকার থেকে রাজনৈতিক কোনো সুযোগ সুবিধা নিইনি। এরপরেও আমাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।
দীর্ঘ সময় বিটিভি-বেতার ও শিল্পকলায় আমি গান করার সুযোগ পাইনি। একজন শিল্পী হিসেবে এটি আমাকে কষ্ট দেয়। আমার অনেক সহকর্মীও আমাকে একটা রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে বিভিন্ন সময় নানা অপপ্রচার করেছে। আগামীতে এমন পরিবেশ আর দেখতে চাই না।’
শিল্পী মুহিন বলেন, ‘বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়েও আমি গত কয়েক বছরে কোনো ডাক পাইনি। সত্যি বলতে, সংস্কৃতিকে শেকলে বেঁধে রাখা যাবে না’ দল, গোত্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদে শিল্পীকে কখন আলাদা করা যায় না, শিল্পীরা বেঁচে থাকেন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে, এই সত্যিটা সবার মাঝে তুলে ধরতে হবে। নইলে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছি, তা কখনো পূরণ হবে না।
শিল্পকলা একাডেমি, বিটিভি, বাংলাদেশ বেতারের শিল্পীদের কালো তালিকার খাতা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। সংগীতশিল্পী সোহেল মেহেদী বলেন, ‘বিটিভিতে আমাকে ডাকে না কতগুলো বছর। শেষ কবে বিটিভিতে গিয়েছি তা মনে পড়ে না। মাঝে দুই তিনটা অনুষ্ঠান করলেও আমার পরিচিত একজন কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আমাকে যেন বিটিভির কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা না হয়। এছাড়া তৌহিদ, মাহফুজা গং এজন্য বেছে বেছে তাদের শিল্পীদেরকেই ডাকতো। বিটিভির জিএম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার থেকে শুরু করে সকল শাখায় ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।’