
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) জি.এম.এ.জি. ওসমানী হলের দৃশ্যপট আজ একেবারেই ভিন্ন। সময়ের পরিক্রমায় যেসব অনিয়ম, বৈষম্য, দখলদারিত্ব আর মাদক সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল আজ তার জায়গায় এসেছে শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা ও স্বচ্ছতা। আর হল ব্যবস্থাপনায় এ পরিবর্তনের ধারা শুরু হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে অধ্যাপক ড. মো. সাইদুজ্জামান প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর।
একসময় এই হলে গণরুম সংস্কৃতি ছিল সাধারণ চিত্র। পাস করে গেলেও রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাত্ররা দীর্ঘদিন ধরে হলে অবস্থান করত। নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলে প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে মাঠ ভাড়া দিত, ডাইনিং এ টাকা ছাড়া খেত, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি চালাত। এসব কারণে সাধারণ ছাত্ররা বারবার বঞ্চিত হতেন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে। পাশাপাশি ছাঁদের নির্জন কোনা ও নির্দিষ্ট কিছু রুমে মাদকসেবীদের আড্ডা ছিল নিয়মিত ব্যাপার।
এই দৃশ্যপট পাল্টে দিতে উদ্যোগী হন প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. সাইদুজ্জামান। তার সাথে আছেন সহকারী প্রভোস্ট মো. আনোয়ার হোসেন, সহকারী প্রভোস্ট কামরুল হাসান পলাশ এবং হাউজ টিউটর ফরহাদ আহমেদ।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয় নানা সংস্কার কার্যক্রম। ছাত্ররাজনীতির নেতাকর্মীদের প্রভাব হ্রাসের পাশাপাশি হলজুড়ে পরিচালিত হয় মাদকবিরোধী অভিযান, যার ফলে মাদকের আসর পূর্বের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে। এছাড়া গেল বছর ৮ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে হল পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়।
হল প্রশাসনের অন্যতম বড় পদক্ষেপ ছিল কক্ষ পুনর্বিন্যাস। যা এর ১৫ বছর আগে পূর্বের হল প্রশাসন বাস্তবায়ন করেছিল। অতীতে ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীরা হলে থেকে কক্ষ না ছাড়ায় নতুন ব্যাচের ছাত্রদের উঠতে অসুবিধা হতো। এছাড়া রুম বরাদ্দের ক্ষেত্রে যে এলাকাভিত্তিক বৈষম্য চালু ছিল, এবার তারও অবসান ঘটে। হল প্রশাসন দুপক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি স্বচ্ছ ও যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় রুম বরাদ্দ সম্পন্ন করে, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে আস্থা ফেরায়। এছাড়া হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়েছে।
হলের ছাত্রদের বসবাস সংক্রান্ত বিষয় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা। ৮০ শতাংশ আবাসিক ছাত্রের জন্য শোবার খাট ও ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য পড়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি কক্ষে সিলিং ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হল জুড়ে ঠান্ডা পানি নিশ্চিত করার জন্য পানির কুলার সরবরাহ করা হয়েছে।
হলের ডাইনিং ব্যবস্থাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। ছাত্র প্রতিনিধি, শিক্ষক ও হলের স্টাফদের নিয়ে ডাইনিং পরিচালনা করা হয়। নতুন চেয়ার ও টেবিল সংযুক্ত করা হয়েছে। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে আনফিট খাবার পরিবেশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গণরুম হিসেবে পরিচিত টিভি রুমকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। সেখান যুক্ত করা হয়েছে ৫৩ ইঞ্চির টিভি, টেবিল টেনিস এবং ক্যারাম বোর্ড। তাছাড়া জিম রুমে সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চাহিদাপত্র প্রেরণ করা হয়।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক অগ্রগতি। ক্যান্টিনের পাশে পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ১২০ ফুট দীর্ঘ ড্রেন। তৈরি হয়েছে সাইকেল গ্যারেজ ও স্থাপন করা হয়েছে ফ্রি ওয়াইফাই। প্রভোস্ট কক্ষে ওয়াশরুম ও হল কর্মকর্তাদের জন্য কক্ষকে বর্ধিত করা হয়েছে। মসজিদে ফ্যান, কার্পেট, মাইক সাউন্ড সিস্টেম ও ১০ টন এসি সরবরাহ করা হয়। রিডিং রুমে প্রয়োজনীয় ফ্যান ও বেঞ্চ সরবরাহ করা হয়েছে। মাঠে চারপাশে খেলা দেখার জন্য বেঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মাঠের উত্তর পাশে ময়লার স্তূপ অপসারণ করে ফলের গাছ লাগানো হয়। এছাড়া হল আঙ্গিনায় গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া চলমান আছে এবং বাস্কেটবল কোর্ট ও গেস্টরুম নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চাহিদা পত্র দেওয়া হয়।
অফিস ব্যবস্থাপনাতেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হলের সকল আবাসিক ছাত্রের প্রয়োজনীয় তথ্যসম্পন্ন ডেটাবেইজ তৈরি করা হয়েছে। হলের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং হলের অটোমেশনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত আপডেট দেওয়ার জন্য গ্রুপ খোলা হয়েছে।
ওসমানী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী হামিদ হোসাইন আজাদ বলেন, প্রথম বর্ষের শেষের দিকে ছাত্রলীগের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি এলাকা ভিত্তিক জোনের শিক্ষার্থীদের জিমরুমে(গণরুম) তোলা হয়েছিল। ফ্যান সংকট, ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং এক সঙ্গে গাদাগাদি করে অনেক জন সব মিলিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অনেকেরই টিকে থাকা সম্ভব হয় নি। এছাড়া রুমে থাকাকালীন ছাত্রলীগ জোর করে মিছিলে নিত। বেশ কয়েকমাস গণরুমে থাকার পর হল প্রভোস্ট স্যার আমাদের অ্যালটমেন্ট নেওয়ার নির্দেশ দেন। তখন অনেকে বলতো স্যার রুম দেওয়ার কেউ নয়। রুম দিবে ছাত্রলীগ এবং তখন গণরুম মেইনটেন করে, প্রোগ্রামে উপস্থিত থেকে রুম এর অধিকার আদায় করার প্রচলন ছিল। কিন্তু স্যার একদিকে আমাদের অ্যালটমেন্ট নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন অন্যদিকে অবৈধভাবে দখল করে রাখা রুম পুনরুদ্ধার করছেন। তখন আমরা বুঝতে পারি স্যার যথেষ্ট আন্তরিক হলের অনিয়ম দূর করতে। তাই আমরা আর এই অনিয়মের অংশ হয়ে থাকতে চাইনি। ছাত্রলীগের অপশাসনের সময় স্যার এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত হলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এছাড়া মৃতপ্রায় ডাইনিং সিস্টেম চালু করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাজ করছে, হলের মাঠ ভাড়া দেওয়া নিষিদ্ধ, ক্যান্টিন থেকে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। হলে নতুন ফ্যান, মসজিদের সংস্কার, রুম সমূহের ইলেকট্রিসিটি সমস্যা সমাধান করা হয়েছে।
হল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. সাইদুজ্জামান বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল আমাদের সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চটা করা। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের যেসব সুবিধা থাকার কথা, সেগুলো নিশ্চিত করা, এমনকি তার চেয়েও ভালো কিছু করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। আলহামদুলিল্লাহ আমরা হল প্রশাসন ছাত্রদের সহযোগিতায় হলের সার্বিক পরিবেশ অনেকটাই উন্নত করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের প্ল্যান মোতাবেকই আমরা এগুচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, হলের কোনও বার্ষিক বাজেট না থাকায় আমরা অনেক কাজই করতে পারি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা অল্প পরিসরেই অনেক কিছু করতে পেরেছি। ছাত্রদের ফার্নিচার, ইন্টারনেট, স্পোর্টস, জিমনেশিয়াম অবকাঠামোগত উন্নয়ন সবকিছু আরও গতিশীল হতো বার্ষিক বাজেট থাকলে। আবাসিক ছাত্রদের কাছ থেকে আমরা যে টাকা নিচ্ছি, সেটা দিয়ে মূলত তেমন কিছু করা যায়না। হলকে সচল রাখতে এবং হলের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ছাত্রসংখ্যা এবং হলের সাইজ অনুসারে বার্ষিক বাজেট প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে অধ্যাপক সাইদুজ্জামান জানান, একটি আধুনিক রিডিং রুম, জিমনেশিয়াম, বাস্কেট কোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি, হলের পরিসর বিবেচনায় আরও জনবল প্রয়োজন, যেটি উপাচার্য মহোদয়কে জানানো হয়েছে এবং তিনি দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি প্রত্যাশা করেন, ভার্সিটির ক্লাস এর সময়টুকু বাদে যেহেতু দিনের পুরো সময়টাই ছাত্ররা হলে কাটায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা যেন হলে নিশ্চিত করা যায়। একটা সুস্থ সুন্দর আবাসিক পরিবেশ একজন ছাত্রের গুণাবলিতে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে।
আঁখি