ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগার: শতবর্ষ পেরিয়ে জ্ঞানের নিরব আলোকধারা

মোছাঃরোকেয়া সুলতানা, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রাজশাহী কলেজ

প্রকাশিত: ০১:০২, ১২ জুলাই ২০২৫

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগার: শতবর্ষ পেরিয়ে জ্ঞানের নিরব আলোকধারা

একটি নির্জন ঘর, চারপাশে বইয়ের গন্ধ, শব্দহীনতায় ডুবে থাকা কিছু চোখ—ঠিক এমন দৃশ্য দেখা যায় রাজশাহী কলেজের গ্রন্থাগারে। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পায়ের ছাপ মাড়িয়ে যে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে আছে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ একাডেমিক বাতিঘর হিসেবে, তার নিঃশব্দ প্রাণ হলো এই পাঠাগার। এটি শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, বরং একেকটি পাতায় লুকিয়ে থাকা হাজারো সম্ভাবনার দরজা। এখানে বই পড়া মানে নিজের ভেতর আলো জ্বালানো, নিজেকে আবিষ্কার করা।

১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজের প্রতিষ্ঠার পর, বইয়ের প্রয়োজন ছিল ছাত্র-শিক্ষকদের প্রথম চাহিদা। সেখান থেকেই জন্ম নেয় এই পাঠাগার। প্রথমদিকে এটি ছিল ছোট পরিসরে, কিছু দরকারি বইয়ের সমষ্টি মাত্র। কিন্তু সময় বদলেছে, প্রজন্ম এসেছে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে—গ্রন্থাগারও বেড়েছে, বদলেছে, এবং একসময় দাঁড়িয়ে গেছে উত্তরবঙ্গের অন্যতম সমৃদ্ধ রিসার্চ লাইব্রেরি হিসেবে।

এখন এই গ্রন্থাগারে রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার বই। তবে সংখ্যা নয়, এই সংগ্রহের বৈচিত্র্যই একে আলাদা করে। বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক থেকে শুরু করে ইংরেজি গবেষণাপত্র, ইসলামিক স্টাডিজ থেকে দর্শনের চিন্তাপ্রবাহ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—প্রায় প্রতিটি বিষয়ে বই পাওয়া যায় এখানে। রয়েছে শতবর্ষ পুরোনো ম্যাগাজিন, মানচিত্র, গবেষণাপত্র আর এমন কিছু রেফারেন্স বই যা বাংলাদেশের অন্য কোনো কলেজ লাইব্রেরিতে বিরল।

এই পাঠাগার শুধু বই রাখার স্থান নয়—এটি রাজশাহী কলেজের চিন্তাশীল হৃদয়। এখানকার টেবিলগুলোয় বসে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীরা তৈরি করছেন তাদের ভবিষ্যৎ। কেউ বিসিএসের জন্য পড়ছে, কেউ থিসিস লিখছে, কেউ নিছকই পড়ার আনন্দে মগ্ন। চারপাশে নীরবতা, মাঝেমধ্যে পাতার শব্দ—এই পরিবেশ যেন পাঠককে বইয়ের ভেতর টেনে নেয়।

তবে সবচেয়ে বড় সম্পদ এখানে হলো পরিবেশ। হয়তো এসির হাওয়া নেই, মডার্ন ডিজিটাল স্ক্যানার নেই—তবু এই লাইব্রেরির কক্ষে যে মনোসংযোগ, সে তুলনায় দামি যন্ত্রপাতি নিছকই বাহুল্য। পরিচ্ছন্ন কাঠের টেবিল, দেয়ালের ধারে গুছিয়ে রাখা বইয়ের তাক, ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা—সব মিলিয়ে এক মননশীল পাঠপরিবেশ।

লাইব্রেরির ব্যবহারও সহজ। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কলেজ আইডি দেখিয়ে বই ইস্যু করা যায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নিয়মমাফিক ফেরতের সুযোগও রয়েছে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি কার্ড সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট বই ঘরে নিয়েও পড়তে পারেন।

এই গ্রন্থাগারের সবচেয়ে প্রভাবশালী দিক হলো—এটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জানে, আবার অতীতকে ধরে রাখতেও পারে। যেখানে একদিকে একাডেমিক চাপে ক্লান্ত শিক্ষার্থী খুঁজে পায় প্রশান্তির জায়গা, সেখানে অন্যদিকে গবেষক পান তথ্যভান্ডারের ঠিকানা। আজকের প্রজন্ম যদি চায়, তবে এই পাঠাগার থেকেই তৈরি হতে পারে নতুন সমাজ চিন্তক, নতুন কবি, কিংবা নতুন পথনির্দেশক।

একেকটি লাইব্রেরি আসলে কেবল বইয়ের সংগ্রহ নয়, বরং এটি একটি সমাজের মানসিক উচ্চতার প্রতিচ্ছবি। রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগার সেই প্রতিচ্ছবিতে শুধু উজ্জ্বল নয়, বরং আলোকিত। এই প্রতিষ্ঠানের দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে শতবর্ষের ঘ্রাণ, জানালার পাশে রাখা বইয়ের মাঝে লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের আলোর রেখা।

এখন দরকার এই ধনভাণ্ডারকে সময়োপযোগী করা—ডিজিটাল ক্যাটালগ, অনলাইন বুক এক্সেস, ই-রিসোর্সসহ আধুনিক ব্যবস্থা যুক্ত হলে, এটি শুধু রাজশাহী নয়, গোটা দেশের কলেজ লাইব্রেরিগুলোর জন্য এক আদর্শ হয়ে উঠবে।

রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগার—এটি নিছক একটি লাইব্রেরি নয়, এটি এক জ্ঞানময় যাত্রার নিরব সঙ্গী, যেখানে প্রতিটি পাঠক তার স্বপ্নের সিঁড়ি খুঁজে নেয়, একেকটি পৃষ্ঠায়।

 

রাজু

×