জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
বছরের পর বছর নিম্ন মানের প্রতিষ্ঠান দিয়েই বইয়ের মান তদারক করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। যেসব তদারক কোম্পানি মান যাচাইয়ের কাজ করছে না আছে তাদের সক্ষমতা, না আছে জনবল। বরং প্রতিবছর দেখা যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৯০-৮০ শতাংশ কম দিয়ে যেনতেনভাবে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুদ্রাকর ও তদারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ধরণের যোগসাজস রয়েছে। আর সম্মিলিত এই সিন্ডকেট সবার চোখে ধুলো দিয়ে নি¤œমানের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কারণ কাগজে কলমে বইয়ের মান ঠিক দেখাচ্ছে এসব কোম্পানি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বইয়ের দৃশ্য ভিন্ন। তবে এনসিটিবি বলছে, ভবিষ্যতে তদারকির সব দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া হবে। নাম সর্বস্ব কোম্পানি আর বইয়ের তদারকি করতে পারবে না।
চলতি বছর মাধ্যমিকের বই তদারক করতে দরপত্র আহবান করে এনসিটিবি। এতে অংশ নেয় ৬টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দেখা গেছে বোর্ড যে প্রাক্কলিত দর ধরেছে তার ৯৪ শতাংশ দর কম দিয়েও শুধুমাত্র কাজ পাওয়ার জন্য দরপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। এতে প্রায় ৩১ কোটি বইয়ের মান যাচাই যে কেমন হবে তা নিয়ে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের মধ্যেও সংশয় দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ ভারত নিয়ন্ত্রিত একটি ফরাসী কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়েছে। যা নিয়ে সব স্তরেই উঠেছে সমালোচনার ঝড়।
প্রতিবছর মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের রং, আকার, কাগজের মান ও কালি ঠিকঠাক আছে কী না তা যাচাইয়ে প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) করে এনসিটিবি। এর জন্য দরপত্রের মাধ্যমে তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবছর ৭৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত দর হিসেবে দরপত্র আবহান করে এনসিটিবি। ৬টি কোম্পানি এই দরপত্রে অংশ নেয়। কোম্পানিগুলো হলো- ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি, শেখ ট্রেডিং, ইনফিনিটি বিডি, কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডি, হাইটেক বিডি এবং ব্যুরো ভেরিতাস। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও কাজ পেয়েছে সর্বোচ্চ দরদাতা ফরাসী কোম্পানি ব্যুরো ভেরিতাস। দরপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি প্রাক্কলিত দর ৭৫ লাখ টাকা হলেও এই কাজটি করতে ১৫ লাখ টাকা লিখে দরপত্র জমা দেয়। শেখ ট্রেডিংয়ের দরপত্র মূল্য ১৯ লাখ টাকা। ইনফিনিটি বিডির দরপত্রে লেখা ২০ লাখ ৬০ হাজার। এছাড়াও কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডি ৯ লাখ, হাইটেক বিডি ৩ লাখ ৯৯ হাজার ও ব্যুরো ভেরিতাস ৩২ লাখ ৬১ হাজারে দরপত্র জমা দেয়।
দরপত্রে এমন অংশগ্রহণ ও কাজের মান নিয়ে আশ্চর্য হয়েছেন এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ধরেন আমি বললাম আমার একটি কাজ করে দেন। আমি ১০০ টাকা দর দিবো। কিন্তু আমার এই কাজ যারা করে দিবে বলে দরপত্র কিনেছে তারা বলেছে আমি কাজটি ৬ টাকায় করে দেব। কেউ বলেছে ১০ টাকায় করে দেব। বিষয়টি বিষ্ময়কর। আমি ১০০ অফার করার পরও তারা ৬ টাকায় কাজ করতে চাইছে। এতে স্পষ্ট তাদের অভিসন্ধি ভাল নয়। আবার তাদের বিরুদ্ধে আগেও নানা অনিয়মের অভিযোগ করেছে। এসব বিবেচনায় অন্তত ৫টি কোম্পানি কাজ পায়নি। আবার যারা কাজ পেয়েছেন তাদেরকে ভারতীয় কোম্পানি বলা হচ্ছে। কিন্তু এটি একটি ফরাসী কোম্পানি। তাদের কাগজপত্রে এমনটাই রয়েছে।
কিন্তু যারা কাজ পাননি এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী বলছেন, ব্যুরো ভেরিতাস ফরাসী কোম্পানি হলেও তারা মূলত ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়াও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে নিম্ন মানের কাজ করার দায়ে ও অনিয়মের কারণে বড় সড় জরিমানা গুণতে হয়েছে। এসব কাজের জন্য যে মেশিনারীজ দরকার সেটিও তাদের নেই। যেকারণে এনসিটিবি চোখ বন্ধ করে এই কোম্পানিকে কাজ দিয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।
তবে অন্য যেসব দেশী কোম্পানি আছে তারা এই কাজ দীর্ঘদিন করলেও এখন পর্যন্ত এই কোম্পানির কোন ওয়েবসাইটও তৈরি হয়নি। বরং নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে দুই তিনজন সিন্ডিকেট তৈরি করে এই তদারকি কাজ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত বছর অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রে মাধ্যমিক পর্যায়ের বই নি¤œমানের কাগজ দিয়ে ছাপানো হয়। নিম্ন মানের কাগজকে ভালোমানের দেখিয়ে বিল তুলতে ১৮ কোটি বইয়ের পিএলআই (পোস্ট ল্যান্ডিং ইন্সপেকশন) রিপোর্ট জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। যার সঙ্গে যুক্ত দুইটি প্রতিষ্ঠানের আপন দুই সহোদরের জড়িত ছিল। জানা গেছে, খারাপ কাগজ দিয়ে বই ছাপিয়ে লটপ্রতি লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নেয় ব্যবসায়ীরা। যার সঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কতিপয় সদস্য জড়িত বলেও জানা গেছে। এসব কারণে গত বছর ১৩টি পিএলআই রিপোর্ট জব্দ করে এনসিটিবি। অর্থ লেনদেনের যে বিষয়ে তদন্ত করে। কিন্তু সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও শাস্তির বিষয়টি আর সামনে আসেনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিমার্জন করে। এ ছাড়াও প্রতি বছর প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপায়। গত কয়েক বছর সরকারি অর্থে নিম্ন মানের বই ছাপানোর কারণে সমালোচনার মুখে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, গতবছর ৯৭ শতাংশ প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দাম দিয়ে এই কাজ বাগিয়েছিল দেশীয় কোম্পানি। এবার তারা ৯৪ শতাংশ লেসে দরপত্র জমা দিয়েছে। তারা যে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রিপোর্ট দেয় সেটা আমরা জানতে পেরেছি। শুধু তাই নয়, এই কাজ যেন তাদেরকে দেওয়া হয় এজন্য ২০ লাখ টাকা ঘুষ অফার করা হয়েছে। তিনি বলেন, যাকে ভারতীয় কোম্পানি বলা হচ্ছে সেটি একটি মাল্টিন্যাশনাল ফরাসী কোম্পানি। যারা সারা বিশ^ব্যপী কাজ করে। তাদের মেশিনারীজের সংকটের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এই কোম্পানির একটি মেশিন দেশে নেই। সেটি এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আসবে। এবং ভবিষ্যতে পিডিআই, পিএলই সব তদারকি সেনাবাহিনীকে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আর কে