
উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষিত
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত হয়ে ঝুলে আছেন বছরের পর বছর। না তারা চাকরি ফিরে পাচ্ছেন, না পাচ্ছেন প্রাপ্য অর্থ। বিষয়টির স্থায়ী মীমাংসার জন্য উচ্চ আদালত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশে দিয়েছে। আদালতের নির্দেশের তিন বছরেও নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের চাকরিবিধি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে ছয় মাসের বেশি সাময়িক বরখাস্তের সুযোগ নেই। হয় তাকে বরখাস্ত করতে হবে, না হয় স্বপদে বহাল করতে হবে। সাময়িক বরখাস্ত বছরের পর বছর চলতে পারে না।
বিধি যাই থাকুক, বাস্তবতা ভিন্ন। সর্বশেষ শিক্ষক বরখাস্তের বিষয়ে একটি মামলায় মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠেছে। তখন এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হলেও স্থায়ীভাবে নীতিমালা এখনো হয়নি। ফলে শিক্ষক ভোগান্তি ও আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
মাউশি সূত্র জানায়, শিক্ষাবোর্ড, মাউশি কিংবা বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি শিক্ষকদের বরখাস্ত করে। কোনো শিক্ষক একবার সাময়িক বরখাস্ত হলে স্বপদে ফিরতে তাকে নানা বাধার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে বছরের পর বছর ঘুরে চাকরি ফিরে পেলেও বঞ্চিত হচ্ছেন বেতন ভাতা থেকে। এ সংক্রান্ত পরিপত্রের তোয়াক্কা করছে না শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
এই আদেশ বাস্তবায়নে ম্যানেজিং কমিটিই মূল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের নির্দেশনার পর মাউশি থেকে সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে চিঠি দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এখনো নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ডও অসহায়।
জানা যায়, এ বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডের ১৯৭৯ সালের একটি রেজুলেশনও রয়েছে। বরখাস্তের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ‘কোনো শিক্ষকের ৬০ দিনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত করার সুযোগ নেই।’ এরপরও বছরের পর বছর শিক্ষকদের বরখাস্ত করে রাখা হচ্ছে। মাউশি কর্মকর্তারা জানান, এ বিষয়ে আইন নেই। মন্ত্রণালয়ও এই প্রজ্ঞাপনের তোয়াক্কা করে না।
মাউশির আইন শাখা সূত্রে জানা যায়, উচ্চ আদালত একটি গাইড লাইন দিয়েছে। প্রথমত ৬০ দিনের বেশি হলে তাকে বেতন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩৬-৫৭ নম্বর মামলায় ১৮০ দিনের বেশি হয় তাকে স্বপদে বহাল করতে বলা হয়েছে। এদিকে মামলা থাকলে মামলা চলবে। তবে কোনো শিক্ষক ফৌজদারি মামলা, হত্যা মামলা অথবা জঙ্গি মামলায় অভিযুক্ত হলে বিষয়টি ভিন্ন হবে।
বরখাস্তকালীন সময়ের পর জনবল কাঠামোর ৫ ধারা অনুসারে ম্যানেজিং কমিটি তার বকেয়া টাকা ফেরত দেবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটি কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সুরাহা হয় না শিক্ষকদের বেতনের। মাউশির আইন কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষাবোর্ড চাইলেই ওই ম্যানেজিং কমিটি ভেঙ্গে দিতে পারে। শিক্ষাবোর্ডে আরবিটিশনেরও (আদালত বসানোর মত) সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষকরা কেন বকেয়া টাকা পায় না এ বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, এমপিওর টাকা হচ্ছে উন্নয়ন তহবিলের টাকা। অর্থবছরের মধ্যে এই টাকা খরচ করার সুযোগ রয়েছে। টাকা ফেরত গেলে তা আর পাবার সুযোগ নেই। রাজস্ব খাতে যেসব কর্মকর্তা আছে তাদের হিসাব আলাদা। তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও রাজস্বের কর্মচারীরা কাজে যোগদান করলেই সেই অর্থ ফেরত পান। সাময়িক বরখাস্ত সম্পর্কিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একটি পরিপত্র রয়েছে। ২০১৭ সালের ৬ আগস্ট জারিকৃত এই পরিপত্রে স্বাক্ষর করেন যুগ্ম-সচিব সালমা জাহান। এতে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট পিটিশন নং ৩৬৫৭/২০১৫ এর রায়ে বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষককে ৬০ দিনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত না রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ৬০ দিনের বেশি সাময়িক বরখাস্ত রাখা হলে ওই শিক্ষক বেতন ও অন্যান্য ভাতা সমুদয় প্রাপ্য হবেন। বিষয়টি অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এরপরও উচ্চ আদালতের রায় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র এখনো মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।
উচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষিত
মাগুরা সদরের বাহারবাগ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাদশা মিয়া। ২০০৭ সালে ম্যানেজিং কমিটি তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে। বছরের পর বছর পার হলেও স্কুলে তিনি যোগদান করতে পারেননি। প্রায় ১০ বছর পর ২০১৭ সালে তিনি যশোর শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে তার সাময়িক বহিষ্কার বাতিল চেয়ে আবেদন করেন কিন্তু কোনো প্রতিকার হয় না।
শেষমেশ ওই বছর উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তার সাময়িক বহিষ্কার প্রত্যাহার করে সাতদিনের মধ্যে স্বপদে বকেয়া বেতনাদিসহ পুনর্বহালের জন্য ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেন আদালত। এরপরও কোনো সুরাহা না হওয়ায় ভুক্তভোগী শিক্ষকের আইনজীবী হুমায়ুন কবির বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সাময়িক বহিষ্কারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকা প্রয়োজন উল্লেখ করে পিটিশন ফাইল করেন।
উচ্চ আদালত ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একটি রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ‘সাময়িক বহিষ্কৃত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রক্রিয়া শুরু অথবা সাময়িক বহিষ্কারের মধ্যে যা পূর্বে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বাতিল হয়ে যাবে এবং তিনি বকেয়া বেতনাদিসহ স্বপদে বহাল হবেন।’ রায়ে এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন প্রণয়নে সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এরপরও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় উচ্চ আদালতে অবমাননার দরখাস্ত করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ আদালত অবমাননা পিটিশন নং ২২৬/২০২৩ এর ২০/০৬/২০২৩ তারিখের আদেশে হাইকোর্টের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় কেন আদালত অবমাননা হবে না এ মর্মে কারণ দর্শানোর রুল ইস্যু হয়।
এ প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদালতের আদেশ অনুযায়ী বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য ২০২৩ সালের ১১ জুন শিক্ষা অধিদপ্তরকে অনুরোধ করেন। মাউশির আইন উপদেষ্টা গত ২০২৩ সালের শেষের দিকে লিখিত মতামত প্রদান করেন। এতে বলা হয়, ‘মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনার আলোকে সাময়িক বরখাস্তকৃত শিক্ষকদের বিষয়ে চাকরি বিধিধমালা ১৯৭৯ এর আলোকে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা/রেগুলেশন প্রণয়ন করা দরকার’।
হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা এবং মাউশির আইন বিভাগের মতামতের পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নীতিমালা তৈরি হয়নি। মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও উক্ত বিষয়ে যথেষ্ট উদাসীনতা রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ফলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অগনিত ভুক্তভোগী শিক্ষক প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষকদের বরখাস্তের বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডে আদালতের মতো একটি শুনানি হয়। দুই পক্ষের উকিলের মতো প্রতিনিধি থাকে। সেখানে আরবিটারি কমিটি শুনানি শেষে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সেটি ম্যানেজিং কমিটি না মানলে কমিটি বাতিল করার সুযোগ আছে। তবে এ সংক্রান্ত বেশকিছু অভিযোগও রয়েছে বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, কোনো শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা তদন্ত করি। এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। তবে কোনো মামলা থাকলে সে বিষয়টি তখন আলাদা।
গত এক বছরে কতগুলো ব্যবস্থা নিয়েছেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, তেমন কোনো অভিযোগ আসেনি, যে কারণে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। কেউ যদি নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নিয়ে আসে, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে আমাদের আরবিটশনারি একটি কমিটিও আছে।
নীতিমালা না থাকায় এ বিষয়ে ভোগান্তি বাড়ছে স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, নীতিমালার বিষয়টি দেখভাল করবে মাউশি ও মন্ত্রণালয়। ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি যেহেতু আমরা গঠন করি, সে কারণে ঝামেলাটাও আমাদের পোহাতে হয়। এমপিও নীতিমালা থেকে শিক্ষকদের জন্য অনেক নীতিমালা আছে। একটি নীতিমালায় এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করলেও ভোগান্তি নিরসন সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
এবি