
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কাব্য, সংগীত ও চিন্তাধারায় আজও সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ঔপনিবেশিক শাসন, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর সাহসী উচ্চারণ বাংলার জনমানসে সৃষ্টি করেছে অপরিমেয় প্রভাব। কবির সেই চেতনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ২০০৬ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একাডেমিক জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নয়, এটি নজরুলের আদর্শ, জীবনদর্শন ও সৃজনশীলতার একটি জীবন্ত স্মারক।
স্থাপনায়, নামকরণে নজরুল
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অবকাঠামো, সেবা, পরিবহন ব্যবস্থা কিংবা অবকাশের স্থানসমূহের নামকরণে রয়েছে নজরুল-অনুপ্রাণিত ছোঁয়া। ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’ থেকে শুরু করে ‘গাহি সাম্যের গান মঞ্চ’ বা ‘জয়ধ্বনি মঞ্চ’—সবগুলো নামই কবির কবিতা, জীবনী বা সৃষ্টির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ক্যাফেটেরিয়ার নাম ‘চক্রবাক’ ও ‘চন্দ্রবিন্দু’, কবির গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখা হয়েছে। মেডিকেল সেন্টারের নাম ‘ব্যথার দান’—কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামে। ক্যাম্পাসের কেন্দ্রস্থলে শ্যামল চৌধুরীর নির্মিত নজরুল ভাস্কর্যটি একদিকে যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি কবির বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
পদ্ম পুকুরের পাশে রয়েছে ‘অঞ্জলি লহ মোর’ শিরোনামে আরেকটি মনোমুগ্ধকর ভাস্কর্য, যার নাম নেওয়া হয়েছে কবির সঙ্গীত থেকে।
‘ধ্রুব ৭২’ নামক ভাস্কর্যটি নজরুলের চলচ্চিত্রাভিনয়ের স্মারক এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানকেন্দ্রিক প্রথম ভাস্কর্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন সেবায় ব্যবহৃত বাস ও মাইক্রোবাসগুলোর নামও নজরুলের কবিতা, গান, গ্রন্থ ও চরিত্র থেকে চয়ন করা হয়েছে: ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’, ‘ধূমকেতু’, ‘রনভেরী’, ‘নতুন পথিক’, ‘দূরের বন্ধু’, ‘আগমনী’—প্রত্যেকটি নামেই রয়েছে এক সৃজনভিত্তিক গল্প।
আবাসন ও বৃত্তিতে
উপাচার্যের বাসভবনের নাম ‘দুখু মিয়া বাংলো’, নজরুলের শৈশব নাম থেকে নেয়া। ছাত্র-ছাত্রীদের হল ‘অগ্নিবীণা’, ‘দোলনচাঁপা’, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটরি ‘সন্ধ্যাতারা’, ‘তরণী’, ‘ছায়াবীথি’সহ আরো কয়েকটি নাম নজরুল সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ থেকে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ শুধু গবেষণার কেন্দ্রই নয়, শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করার ক্ষেত্রেও নজরুল পরিবারের সদস্যদের নামে বৃত্তি দিয়ে নজরুল-সংসৃতিকে জাগ্রত রাখছে। ‘প্রমীলা বৃত্তি’, ‘সব্যসাচী বৃত্তি’, ‘অনিরুদ্ধ বৃত্তি’, ‘বুলবুল বৃত্তি’, ‘উমা কাজী বৃত্তি’ ও ‘কল্যাণী কাজী বৃত্তি’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সংস্কৃতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
শিক্ষা ও চেতনার মেলবন্ধন
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নিছক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়—এটি এক ধরনের চেতনার ধারা, যেখানে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি বিকশিত হয় সাংস্কৃতিক ও মানবিক বোধ। ত্রিশালের এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—নজরুল কেবল কবিতায় নন, আমাদের চিন্তা ও চেতনাতেও অনিবার্যভাবে উপস্থিত।
প্যানেল