জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধি
এতদিন বাংলাদেশ সরকার যে ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু রেখেছিল তা ক্রমেই সহনশীলতার বাইরে চলে যাওযায় প্রতিদিন এই ভর্তুকি বাবদ ৯০ কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছিল। এর আগে গত নবেম্বরে সরকার ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি।
একইভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ। সরকারী কোম্পানিগুলোর আবেদনের পর গত ৫ জুন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয় ও গ্যাস বিল ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়। বিইআরসির কারিগরি কমিটি পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল গত মে মাসে, যার ওপর এ মাসেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। শক্তি সংক্রান্ত সব কিছুরই দাম বাড়াতে চলেছে সরকার ভর্তুকি তুলে দিয়ে।
রাতারাতি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাত্রায় এর নানা প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবহন খরচ বেড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর প্রভাব পড়েছে এবং সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মানুষের আয় বাড়েনি অথচ ব্যয় বেড়েছে, ফলে মৌলিক চাহিদা পূরণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে নিরক্ষরতা, বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, অপরাধ প্রবণতাসহ নৈতিক মূল্যবোধেরও অবক্ষয় ঘটে এবং সমাজ পিছিয়ে পড়ে। উন্নয়নের মূল কথাই হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুত, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের অবসান, উৎপাদন উন্নয়ন, সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ বিধায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কৃষির ওপর, কৃষি উৎপাদন খরচ থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে খরচ বেড়ে গেছে অনেক আর এর প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার ঘোষণা দিয়ে সারের দাম বাড়িয়েছে প্রতি কেজি ১৬ টাকা থেকে ২২ টাকায় অর্থাৎ সারের দাম বাড়ার শতকরা হার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। পেট্রোপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিটা সরাসরি বিরূপ প্রভাব ফেলবে দেশের কৃষকদের ওপর। প্রাকৃতিকভাবে সেচের ব্যবস্থা নেই, কৃষককে নির্ভর করতে হয় যান্ত্রিক সেচের ওপর, ভরা বর্ষা মৌসুমে বরেন্দ্র এলাকায় বৃষ্টি নেই, এ বছরের আমন চাষের আবাদ যান্ত্রিক সেচ দিয়ে করতে হয়েছে। কৃষকরা এখন গরু দিয়ে জমি চাষ করে না, চাষের জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করে থাকেন যা ডিজেলচালিত। ধান মাড়াই এবং যে কোন কৃষিপণ্যের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন ডিজেল। তাই এই মূল্য বৃদ্ধিটা মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে কৃষি পণ্য উৎপাদনে।
ডিজেলের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, গ্রামের হাটে ধান বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকায়, ডিজেলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধানের দাম যদি বাড়ানো হয় তবে দাম ৫০ শতাংশ বাড়ত। এই হিসেবে প্রতি মণ ধানের মূল্য হবে ২ হাজার টাকা অথচ বর্তমানে ১ হাজার টাকা ধানের দাম থাকার পরও মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে, আর এই দাম যদি ২ হাজার টাকা হয়, তাহলে মোটা চাল কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি হয়ে যাবে। কারণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ডিজেলের দাম বাড়ানোর ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক অর্থাৎ যখন ডিজেলের দাম ৪৪ টাকা করে ছিল তখন এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হতো প্রায় ৮২০০ টাকা আর বিঘা প্রতি ফলন ১০-১২ মণ করে।
এখন ডিজেলে দাম হলো ১১৫ টাকা, অর্থাৎ আড়াই গুণ বাড়ল, বিঘাপ্রতি খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার ৫০০ টাকা, ধানের দাম না বাড়লে কৃষক তার উৎপাদন খরচ কোনভাবেই মেটাতে পারবে না। কারণ একদিকে ইউরিয়া সারের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, মাঠপর্যায়ের ডিলাররা সরকারী রেটের চেয়ে বেশি মূল্যে সার বিক্রি করে থাকে কৃষকদের কাছে। মাঠপর্যায়ের বিক্রির হিসাবটা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে সারের দাম ৬০-৭০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
ইউরিয়া সারের বেড়ে যাওয়া দামটাও যোগ হবে ধানের মোট উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে। সরকারীভাবে শিল্প পণ্য ও সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয় তার উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে। এই নির্ধারিত মূল্য মাঠপর্যায়ে মানা হচ্ছে কি না, তা তদারকির জন্য কাজ করে সরকারী বেশ কয়েকটি দফতর। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেশের কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ অনুসারে তার মূল্য নির্ধারণটা সরকার করে না। তবে শুধু ধানের ক্ষেত্রে সরকার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক কৃষকরা সরকারী নির্ধারিত ধানের মূল্য পাচ্ছে কি না, তা মনিটরিং করতে সরকারী টিমকে দেখা যায় না।
দেশে প্রায় দুই কোটির বেশি কৃষক পরিবার রয়েছে, যদি প্রতিটি পরিবারে গড়ে চারজন করে সদস্য হয়, তাহলে দেখা যাবে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। এই হিসাবটা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণে কাজ করছে না। সরকার যাদের জন্য কাজ করছে তারা মোট জনসংখ্যার সংখ্যালঘু। অথচ এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই সরকারী ব্যয় ভার মিটানো হয়। ডিজেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। তাই শহরের পাইকারিরা কৃষকের উৎপাদিত শাকসবজির মূল্য কমিয়ে দেয়।
আবার ক্রয়মূল্যের সঙ্গে পরিবহন খরচ যোগ করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে অথচ কৃষক তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য কমলেও দেশের বাজারে তা কমতে কখনও দেখা যায় না। ফলে মূল্যবৃদ্ধির চাপটা পড়ে দেশের প্রান্তিক মানুষের ওপর। বর্তমানে মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রান্তিক কৃষকরা। সরকারের ভাবা উচিত কৃষিপণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতির হারও দ্রুত বেড়ে যাবে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও বাংলাদেশ আপৎকালীন সময় মোকাবেলা করার মতো নিজস্ব সামর্থ্য তৈরি করতে পরিনি। করোনা মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক কৃষকরা। বড়-মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা পেয়েছেন করোনায় আর্থিক প্রণোদনা। সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার পরও শিল্প মালিক ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা করোনার অজুহাতে নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত রাখে।
ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা হয়ে যায় বেকার। এই বেকার হওয়া মানুষগুলো গ্রামে ফিরে আসে যারা মূলত প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। বাংলাদেশ সরকার আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সে শর্ত পূরণ করা হচ্ছে, এছাড়া রয়েছে চীনের কাছে ঋণ। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি গাড়িতে ব্যবহারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা আসবে। ভারতে ইতোমধ্যে ইলেকট্রিকাল যানবাহন খুব দ্রুত বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎচালিত ওজনে হালকা ছোট গাড়ি। সেখানে বাংলাদেশ, জাপান বা কোরিয়ার ব্যবহৃত ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশের সময় হয়েছে দেশের মাটিতে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করার।