আরাফাত রুবেলের খামার
উচ্চশিক্ষিত হয়ে হতে হবে বিসিএস ক্যাডার বা কোন উর্ধতন কর্মকর্তা। এমন ভাবনা অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর। গতানুগতিক এই চিন্তা থেকে বেড়িয়ে কিছু ছেলেমেয়ে নিজেকে উপস্থাপন করছে ভিন্নভাবে। তেমনই একজন আরাফাত রুবেল। পড়ালেখা করেছেন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির চারুকলা বিভাগে।
চিত্রশিল্পী হয়েও আজ একজন সফল খামারি। তার সফলতার গল্প নিয়ে কথা বলেছেন
জনকণ্ঠের সঙ্গে। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- জাওয়াদ বিন রহমান
শিল্পী থেকে খামারি হয়ে ওঠার গল্পটা বলুন। কোন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আউটডোরে এ্যানাটমি ড্রয়িং দিত, সে সময় গরু-ছাগল মাঠে মাঠে গিয়ে আঁকতে হতো। গরুর শিং, চোখ, নাক, পা এসব বডি আঁকাকে বলা হতো এ্যানাটমি ওয়ার্ক। এই ওয়ার্কের মাধ্যমে পশু-পাখির ওপর একটা ভালবাসা জন্মে যায়। এরপর পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেছি। পাশাপাশি মনে হলো আমি ইচ্ছে করলে গরু নিয়ে কাজ করতে পারি। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদের সময়ে ব্যাপকভাবে গরুর চাহিদা তৈরি হয়। সবাই ভাল এবং আলাদা সুন্দর ধরনের গরু খোঁজে। হাটে-বাজারে যে গরুগুলো সাধারণত দেখা যায় তা কিন্তু হৃষ্ট-পৃষ্ট এবং তেলতেলা থাকে না। এরপর দেখলাম ঢাকায় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে টাইলস করা, ওপরে ফ্যান লাগানো এর মধ্যে গরু লালন-পালন করছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ইউটিউব ঘেঁটে দেখলাম। এরপর আমি অল্প কয়েকটা গরু নিয়ে খামার দিলাম রাজশাহী নগরীর শ্যামপুরে। গরু লালন-পালন করতে গিয়ে দেখি গরুর যে প্রধান খাদ্য ঘাস, এই ঘাস যদি নিজে উৎপাদন করতে না পারি তবে গরু দিয়ে লাভ হবে না। বিক্রির থেকে খাবার খরচ বেশি হবে। তখন আমি হাইব্রিড ঘাসের সন্ধান করলাম। চায়না থেকে ঘাস আনলাম জারা ওয়ান নামের। এই ঘাস একবার কাটলে ১৫ দিনের মধ্যে ম্যাচুরড হয়ে যায়। ১৫ দিন পর পর কেটে খাওয়ানো যায়। তখন আমি চার-পাঁচ বিঘা জমি লিজ নিয়েছিলাম খামারের পাশে। সেখানে ঘাসের চাষাবাদ করি। ফলে আমার খরচ কমে গেল। আমার এই ঘাসের জাত সারা বাংলাদেশেই এখন ছড়িয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এসে নিয়ে যায়। তারাও একটি-দুটো করে গরু লালন-পালন করা শুরু করেছে। এই সেক্টরে বর্তমানে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের প্রচুর আগ্রহ।
খামারি হতে কিছু প্রতিবন্ধকা ছিল, প্রথমত আমার পরিবার চায়নি। তাদের মতে লেখাপড়া করে কেন কৃষক হবে। আমি সেই ধারণা বুঝিয়ে পরিবর্তন করেছি, পড়াশোনা করে কৃষিকাজ করলে সফলতা আরও বেশি আসবে। দ্বিতীয়ত আমার বন্ধু-বান্ধবরাও ভাল চোখে দেখেনি। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে।
আপনার খামারে কতটা গরু আছে? কিভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এগুলো বিক্রি করছেন?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যখন কোন গরু, বাছুর বা ঘাসের মাঠের ছবি আপলোড করি, এক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক হাজার লাইক পড়ে আবার শেয়ার হয়। তখন আমার মনে হলো গরু-বাছুরের প্রতি মানুষের অনেক আগ্রহ। আমি ছোট ছোট কনটেন্ড বানিয়ে আপলোড করি। একটি পেইজ খুললাম ‘সওদাগর এগ্রো’ নামে। এখানে ভিডিও দেখে অনেক তরুণ জানতে চায় কিভাবে করলাম এবং ঘাসের কাটিং সম্পর্কে জানতে চায় আমি তাদের সব রকমের সহযোগিতা করছি। আর একটি বিষয় বলা প্রয়োজন মনে করছি, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কাছে কোন সহযোগিতা চাইলে পাওয়া যায়। তবে তারা এখনও পুরনো যেসব পদ্ধতি, সেখানেই সীমাবদ্ধ। রিসার্চ করে কিভাবে উন্নত করা যায়। সে ব্যাপারে তাদের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।
আমার খামারে প্রায় চার ধরনের ৩০টি গরু আছে। তার মধ্যে ২৭টি কোরবানি উপযোগী। আমি অনলাইনে যেসব ভিডিও দেই, তা দেখেই সবাই ক্রয় করে। যারা আমার ভিউয়ারস তারাই ক্রেতা। আমি গরু কখনও হাটে-বাজারে নেই না। কেননা, সেখানে বিভিন্ন গরু থাকে। সেসব গরু যদি ভ্যাকসিন দেয়া না থাকে বা রোগাক্রান্ত হয়, তবে তা অন্যান্য গরুর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য শুধু অনলাইনে বিক্রি করি ও ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেই। গত বছর যারা নিয়েছে তারা এবারও নক করছে। আমার খামারে চার-পাঁচ লাখ টাকার গরুও আছে। একটি গরুর যে ওজন হয় তার প্রায় ৬৫ শতাংশ মাংস হয়। আমি সুন্দরভাবে ভিডিও আপলোড করি আমার পেইজে। ওজনসহ বিস্তারিত তথ্য দেয়া থাকে। তাই ক্রেতারাও সন্তুষ্ট। গত বছর ৩৩টি গরু বিক্রি করেছি। আমার বিক্রি নিয়ে কখনও টেনশন করতে হয় না।
মোটাতাজাকরণ কি? এটা কি মানব শরীরে ক্ষতি করে?
মোটাতাজা হলো- একটি শুকনা গরু কিনলাম, তারপর তাকে কৃমির ওষুধ দিয়ে কৃমিমুক্ত করি। সাধারণ কৃষকরা জানে না একটি গরুর পেটে যদি কৃমি থাকে, তাকে যতই খাওয়ানো হোক সে শুকনাই থাকবে। কেননা তার খাবার কৃমিতে খেয়ে নেয়। কৃমিমুক্ত করে হাইব্রিড ঘাস বা প্রাকৃতিক ঘাস ও দানাদার খাবার খাওয়াই। গম, ভুট্টা, ডাল দিয়ে একটি পাউডার তৈরি করি। যা পানির সঙ্গে মিলিয়ে গরুকে খাওয়াই। ফলে গরু সহজেই মোটা হয়। একজন সাধারণ কৃষক প্রাকৃতিক ঘাস এবং ঘরের ভাতের মার, ভুসি এগুলো খেতে দেয়। ফলে গরুগুলো শুকনা থাকে। যদি কোন অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত লোভের আশায় ক্ষতিকর কিছু পুষ করে সেসব গরু এক থেকে দুই মাসের মধ্যে মারা যাবে। সাধারণত খামারিরা এগুলো করে না।
তরুণদের জন্য আপনার কি পরামর্শ?
যারা লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে যেতে চায়। তাদের যে পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়, তা দিয়ে ইচ্ছে করলে দেশে একটি খামার দিয়েও সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। একজনের বিদেশে যেতে কম করে হলেও চার-পাঁচ লাখ টাকা লাগে। সে যদি দুই-তিন লাখ দিয়ে কয়েকটি গরু কিনে খামার করে বছরে প্রায় তিন লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া যারা বেকার জীবন কাটাচ্ছেন, তারা চাকরির বাজারে না ঘুরে নিজেই উদ্যোক্তা হবেন। পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। তবে যেকোন কাজেই সফলতা আসবে।