ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

আমের বাজার ও রপ্তানিতে সম্ভাবনা

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৪ জুন ২০২৫

আমের বাজার ও রপ্তানিতে সম্ভাবনা

আম বাংলাদেশের প্রধান ফল হলেও কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর আমের মৌসুমকে ঘিরে চাষি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে সরকারকে নানা নীতি-পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়, আর ভোক্তাদের জন্য সেসব নীতি বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয় গণমাধ্যমে, যার মধ্যে আছে আমের উৎপাদন বাড়ানো, যত্নসহকারে বাগানের পরিচর্যা, গাছে সময়মতো স্প্রে করা, হার্ভেস্টিং, ফল সংরক্ষণ, ভেজালমুক্তভাবে বাজারজাতকরণ, বিদেশে রপ্তানিকরণ ইত্যাদি। আমচাষ লাভজনক হওয়ায় অনেক কৃষক শস্যদানা আবাদ বাদ দিয়ে ফসলি জমিতে মৌসুমি ও বারোমাসি আম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, যা অর্থনীতির জন্য সুখবর। 
অভিজাত আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা বলেছেন, তাদের এলাকায় গাছে আম পাকা ও নামানো শুরু হয়েছে, অন্যদিকে বর্তমান রংপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় হাঁড়িভাঙা, আম্রপালি ও সূর্যপুরী আম সুস্বাদু। দিন দিন বাড়ছে আমের বাজার। 
করোনার সময় থেকে অনলাইনে আম কেনাবেচার প্রবণতা শুরু হলেও বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে আম কেনাবেচার ব্যবসা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।  অপরদিকে আমের মৌসুম শুরু হলেই কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা সরব হয়ে ওঠে। এ সময়ে আমের জেলাগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে, বহু শ্রমিকদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়, বাজারে গতি বাড়ে ও স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। শুধু ফলই নয়, ফলের জুস, আচার, আমসত্ত্ব, লজেন্স, ম্যাংগোবার ইত্যাদির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে আম উৎপাদনে বিশ্বের সপ্তম স্থানে রয়েছে। এই বিপুল উৎপাদনের পরও রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই পিছিয়ে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে আমের চাহিদা বাড়ছেই। 
পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৯ সালের মধ্যে বৈশ্বিক আম বাজারের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। দুঃখজনকভাবে, এত বড় বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় নগণ্য। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছিল ৭৮৮ টন আম। কিন্তু পরের বছরই সেই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৮৮ টনে। এই পতনের মূল কারণ শুধু বৈদেশিক নীতি বা প্রতিযোগিতা নয় বরং আমাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, মান নিয়ন্ত্রণে গাফিলতি এবং একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ীর অনিয়ম। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা চেইনশপ ওয়ালমার্টে বাংলাদেশি আমের প্রবেশ ঘটে। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ওই সময় এফএও, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও সাতক্ষীরার হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আম বাছাই করা হয় রপ্তানির জন্য। কৃষকেরা ব্যাগিং পদ্ধতি গ্রহণ এবং মান নিয়ন্ত্রণে আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ শুরু করেন। 
আন্তর্জাতিক হোলসেল বাজারে প্রবেশ করতে হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মান নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট মানদণ্ড মানতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানির জন্য ইইউ কমপ্লায়েন্স থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে এই বিষয়টি অবহেলিত ছিল। কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে। নাটোর অঞ্চলের টক জাতের আম, যা একসময় দাম না পেয়ে নষ্ট হতো, তা দিয়েই এখন জ্যাম, জুস, চাটনি ইত্যাদি পণ্য তৈরি হচ্ছে। এখানে প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রথমবারের মতো শিল্পপর্যায়ে আম প্রক্রিয়াজাতকরণ শুরু করেন। আজ সেই পথ ধরে দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৭ হাজার ৪৫৯ টন। রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৩ টন। রপ্তানি হয় ১ হাজার ৩২১ টন আম। সরকার আশা করছে, ২০২৫ সালেই অন্তত ৪ হাজার টন আম রপ্তানি সম্ভব হবে। আমাদের আম যদি বিদেশি বাজার জয় করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের কৃষিও পৌঁছাবে এক নতুন উচ্চতায়।
এ ব্যাপারে সরকারি নীতি সহায়তা, প্রসেসিং শিল্প, উৎপাদনে প্রণোদনা, বাজার ব্যবস্থাপনা, আম সংরক্ষণ ইত্যাদি সহায়ক হলে আমের অর্থনীতিতে আসবে চাঙ্গা ভাব। 

প্যানেল

×