
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর দেওয়া চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড় না পেলে দেশের বিনিয়োগ প্রবাহ কিছুটা স্থবির হয়ে যাবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা পাবেন। এই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বেড়ে যাবে। এই অবস্থায় আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে যতটা সম্ভব ঋণ প্রবাহ ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করলেও এ ঋণ প্যাকেজের প্রতিটি কিস্তি নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেলেও চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে পেতে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফের এই শর্তগুলো একদিকে যেমন কাঠামোগত অর্থনৈতিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করতে পারে, অন্যদিকে সরকারের নীতিনির্ধারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর দেওয়া চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি না ছাড়লে দেশের বিনিয়োগ প্রবাহে কিছুটা অসুবিধা হবে। রিজার্ভের ওপরও চাপ বেড়ে যাবে। আমদানিও কমে যাবে। যে কারণে আমাদের বিদেশী বিনিয়োগের ওপর আস্থা বাড়াতে আইএমএফের এই ঋণ অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঋণ প্রবাহ অব্যাহত থাকলে সহজেই চাঙ্গা থাকে দেশের অর্থনীতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা জনকণ্ঠকে বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বাজেটকে কেন্দ্র করে যে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রতিফলন কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি। রিজার্ভের ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পেরেছি।
এই পরিবর্তনের পেছনে কিন্তু আইএমএফের দেওয়া পরামর্শ মানার কারণেই হয়েছে। আর্থিক খাতের সংস্কারের ফলে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। যে কারণে আমাদের অর্থনৈতিক ভাবটা অনেকটাই চাঙ্গা হয়েছে। এদিকে ভূরাজনৈতিক অবস্থাকেও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
আইএমএফের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজস্ব আহরণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, মুদ্রার বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণ কমানো।
বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিন ধরে কাঠামোগত দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করদাতার সংখ্যা কম, করনীতি জটিল, আর রাজস্ব প্রশাসনের মধ্যে রয়েছে অস্বচ্ছতা। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন কঠিন। আবার, এনবিআরের নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসন কাঠামো পৃথক না হওয়া পর্যন্ত কাক্সিক্ষত সংস্কার সম্ভব হবে না বলেই অর্থনীতিবিদদের অভিমত।
ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা আরও গভীর। খেলাপি ঋণ বাড়ছে, পরিচালনা দুর্বল এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখনো দূর হয়নি। আইএমএফ ব্যাংকিং খাত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিলেও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এক বড় বাধা। একইভাবে, রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় আইএমএফ চায় মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হোক। এতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়লেও আমদানি ব্যয় বেড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হতে পারে। এর প্রভাব সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে।
সরকার ভর্তুকি হ্রাসে উদ্যোগ নিয়েছে, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে, ভ্যাট ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটিই দেখার বিষয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন বা অন্য যে কোনো দেশের বিনিয়োগকারীরা বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া শর্ত বাংলাদেশের মানা না মানার বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। তবে আইএমএফের চাপিয়ে দেওয়া শর্ত মানার ফলে নিজেদের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। এটা ভালো বিষয়। তাদের শর্ত ভঙ্গ করলে কিছু বিনিয়োগকারীদের মাঝে সামান্য ভুল ধারণা চলে আসে। তা সাময়িক। এদিকে স্থাানীয় ব্যবসায়ীদের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ালে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা আরও সহজ। এ ছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখলে তাদের মাঝে আরও বেশি আস্থা তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে তিনটি বড় বাধা মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, জিডিপির ০.৫% হারে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ এবং এনবিআরের নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনকে পৃথক করা। এই তিন শর্ত পূরণ না হলে আইএমএফ কিস্তি ছাড়ে অনীহা দেখাতে পারে।
এই অবস্থায় সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতিগত অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া এই সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে দরকার হবে রাজনৈতিক সাহস অর্থাৎ জনস্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সাহসী ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং রপ্তানি ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির জন্য কার্যকর কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
রাজস্ব আহরণে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি করজাল সম্প্রসারণ, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং ভর্তুকিভিত্তিক খাতে বাস্তবসম্মত সংস্কারই হতে পারে ভবিষ্যতের পথনির্দেশক। এখন প্রয়োজন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তা হলেই কেবল এই সংকট মোকাবিলা করে, আইএমএফের কিস্তি ছাড় নিশ্চিত করে, দেশের অর্থনীতিকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব হবে।
এক সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, আইএমএফ যদি অতিরিক্ত শর্ত দেয়, তবে বাংলাদেশ আর এই ঋণ নিতে আগ্রহী থাকবে না। সংস্থাটির সব শর্ত মানলে অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও টেকসই অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এ সময়ে কঠিন শর্ত মেনে নেওয়া যৌক্তিক হবে না। প্রয়োজন হলে আমরা বিকল্প পথ খুঁজে নেব।
উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, ছয় মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউ থেকে বের করে এনেছি। রুগ্ন দশা কেটে গেছে। ভয় পাবেন না, আমরা আছি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ এখন দেশের অর্থনীতির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয়। তাদের ঋণের কিস্তি না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের অর্থনীতি যেমন আছে, তেমনই চলবে। ড. আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য নিজস্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার স্বাধীনভাবে বাস্তবায়ন করা।
চলতি মাসে ঢাকায় আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সফরে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার ছাড়ের বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। মুদ্রার বিনিময় হার অধিকতর নমনীয় করা ও কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়নি। আইএমএফের এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণ শ্রীনিবাসন অবশ্য বলেছেন, ঋণ পাওয়ার বিষয়ে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। তবে কবে নাগাদ চুক্তি হবে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
এদিকে আইএমএফের ঋণ না পেলেও খুব একটা সমস্যা হবে না বলা হলেও এটা দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। আর্থিক খাতের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। একই সঙ্গে অন্যান্য সংস্থার ঋণ পেতে অনেকটা ভূমিকা রাখে। আর তাই আইএমএফের ঋণ পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির নানা বিষয় জড়িত বলে মনে করেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা।