ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

শিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার

জলি রহমান

প্রকাশিত: ০১:১৩, ১৯ মে ২০২৪

শিল্পের বাণিজ্যিক প্রসার

শিক্ষিত হওয়া মানেই কি ভালো চাকরি করা! না

শিক্ষিত হওয়া মানেই কি ভালো চাকরি করা! না। অনেকেই এ ধারণার অবসান ঘটান বেশ সফলতার সঙ্গে। আজকাল পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষার্থীরাও হচ্ছেন সফল উদ্যোক্তা। বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহু উচ্চ শিক্ষিত এসএমই শিল্প উদ্যোক্তা। এদের মধ্যে দেখা যায় কেউ পাট দিয়ে আবার কেউ কাপড় দিয়ে নানা রকম ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করছেন।

কিন্তু নিজের সৌখিনতাকে ভালোবেসে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সংখ্যা কমই চোখে পড়ে। এমনই একজন মো. বখতিয়ার রহমান খান। যাকে সবাই খোকন কারিগর নামেই চেনে। যার স্বপ্ন শুধু কাদামাটি ঘিরেই। স্বাভাবিক জীবন ¯্রােতের বিপরীতে তার পথচলা। 
ঢাকার সাভারের কাতলাপুরে বখতিয়ার কারিগরের বাসা। তার বাসভবনের এক পাশে দেখা যায় টিনের চালার লম্বা একটি কক্ষ। যেখানে রাখা হেেয়ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য। রয়েছে কাঁচামাটির তৈরি পণ্যগুলোকে পোড়ানোর জন্য চুল্লি। একটি অংশে সাজিয়ে রেখেছে কাঠ কাটার যন্ত্রপাতি।

কক্ষের একপাশে কাঠের তাকে রাখা কাঠ ও মাটির মিশ্রণে তৈরি কিছু শিল্পকর্ম। মৃৎ শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় সবই যেন অপূর্ব শোভা ছড়াচ্ছে। বখতিয়ার যেভাবে মাটি দিয়ে হুইলে পটারি বানায় তাতে ফুটে ওঠে সুনিপুণ হাতের দক্ষতা। এক সময়ে শখ করে শুরু করা কাজটাকেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। বখতিয়ার বরাবরই স্বাধীনচেতা মানুষ। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন একটি স্কুলে। সে সময়ে চেষ্টা করেন বনসাই করার।

সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন একই স্কুলের ড্রয়িং শিক্ষক হীরা। বনসাইয়ের জন্য টব বানানো শেখেন তার কাছ থেকেই। তিনি টব বানানোর কাজ শুরু করেন ৩০০ টাকার মাটি দিয়ে। এরপরে বখতিয়ার ও তার তিন সঙ্গী একত্রে কলমদানি, টব এবং ছোট ছোট টেরাকোটা বানানো শুরু করেন একটি বাঁশের বেড়ার ঘরে। অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন মেলায়। তার এই কর্মযজ্ঞের পথ খুব একটা মসৃণ ছিল না।

জীবনের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে সবাই অন্যত্র চলে যান ভালো কাজের আশায়। কিন্তু বখতিয়ার মাটির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। ২০০৪ সাল থেকে কাজ করেন একাই। পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক স্বপন শিকদারের সঙ্গে। তার কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছেন হাতে-কলমে। ২০১০ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে এভাবেই।

২০০০ সালে ¯œাতকোত্তর শেষ করা বখতিয়ারের আর্থিক অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় দেখা দেয় পাবিবারিক অসন্তুষ্টি। খোকন কারিগর জানালেন, আমি দুই ধরনের বাজারের মুখোমুখি হয়েছি। একটা ছিল ঢাকার রাস্তার ফুটপাত। সেখানে যারা মৃৎ পণ্য বিক্রি করত তাদের কাজ বড় আর্টিস্টদের থেকেও নিখুঁত। কেননা তারা বংশ পরম্পরায় এ কাজ করছে। তারা বিক্রিও করত খুব সস্তায়। আরেকটা হলো বিভিন্ন শোরুমে এক্সিবিশন করা। সেখানে বড় শিল্পীরা অংশগ্রহণ করত।

আর আমি ছিলাম মাঝামাঝি অবস্থানে। দীর্ঘ ৯ বছরে আর্থিক সফলতা না আসায় সরকারি চাকরিজীবী বাবাকেও প্রতিবেশীদের নানা বিদ্রুপ কথা শুনতে হয়েছে। শিক্ষিত ছেলে মাটি নিয়ে কাজ করে এমন নানান কটুবাক্য। একপর্যায়ে আমি কাজটা ছেড়ে দেই। এরমধ্যে আইডিয়া ক্র্যাফট এর স্বত্তাধিকারী শ্যামল দা। তার একটি শোরুমে আমার পণ্য নেওয়া শুরু করে। যা আমার জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে।

ছয়টি ডিজাইনের পণ্য দাদাকে দিয়ে আসি। একইসঙ্গে অন্য চাকরি করতে থাকি। এরপর দাদা আরও পণ্য চাওয়া শুরু করল। এবার ৩০টি পণ্য পাঠিয়ে দেই। তখনই আমি মানসিকভাবে স্থির করি, এটাই হবে আমার পেশা। 
মৃৎ শিল্পী বখতিয়ার পারিবারিকভাবে এ কাজ কখনো কাউকে যেমন করতে দেখেননি। তেমনি শেখেননি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকেও। তাই যখনই এ কাজে অভিজ্ঞ কোনো মানুষ পেয়েছেন তখনই তার কাছ থেকে শেখার চেষ্ট করেছেন। স্বপন শিকদারের কাছ থেকে শেখেন মাটি দিয়ে বানানো পণ্য পোড়ানোর বিষয়। এর আগে তিনি অনেক পণ্য পোড়াতে গিয়ে নষ্ট করেছেন। বখতিয়ার এ কাজ ভুল করতে করতেই শিখেছেন।

এখন তিনি একজন পরিপূর্ণ মৃৎ শিল্পী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম মৃন্ময়। মৃন্ময়ের পণ্য তৈরি হয় মাটি, কাঠ, গাছের শেকড় ও গাছপালাসহ নানা জিনিসের মিশ্রণে। এভাবে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে আত্মবিশ^াস। কর্মসূত্রে পরিচয় হয়েছিল মৃৎ শিল্পের পথিকৃৎ মরণ চাঁদ পালের সঙ্গে। হতাশ হয়ে মাঝেমধ্যে তার পরামর্শও নিয়েছেন।

মরণ চাঁদ পালের যে কথা তার জীবনে উদ্দীপনার কাজ করে তা হলোÑ ‘তুমি কাজ করতে থাক। এক সময়ে কাজই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। তখন মাটি মুট করে আগুনে পোড়ালেও লোকে বলবে, ওখানে খোকনের হাতের ছাপ আছে। কাজই তোমাকে সফলতায় পৌঁছে দেবে।’

রং করার কষ বানানো শেখেন তার কাছ থেকেই। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও তার সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তার এ কর্মজীবনে বিপর্যয় এসেছে নানাভাবে। কিছু শোরুম বাকিতে পণ্য নিয়ে আজও টাকা দেয়নি। এরপর থেকে সে ক্যাশ টাকায় বিক্রি শুরু করে।  
খোকন কারিগরের বানানো পণ্য বিক্রি করেছেন প্রায় তিন লাখ টাকার বিনিময়েও। বর্তমানে তিনি জীবন নির্বাহ করছেন এ কাজের মাধ্যমেই। তার রয়েছেন একজন সহযোগী। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একমাত্র মেয়েও বাবার কাজকে ভলোবেসে সহযোগিতা করেন। বখতিয়ারের স্বপ্ন এখন সুদূরপ্রসারী। বর্তমান প্রজন্মকে মাটির সঙ্গে পরিচয় করানোর ইচ্ছে তার ভীষণভাবে।

এ লক্ষ্যে আলাদা করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন কে অ্যান্ড ক্যাফে নামে। এটি হবে মৃন্ময়ের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। সেখানে শিশু থেকে বড় সবাই খাওয়া-দাওয়ার পাশাপশি ছুঁয়ে দেখতে পারবেন মাটি। নিজেরাই কাঠ, মাটির মিশ্রণে বানাতে পারবেন নানা পণ্য। প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন খোকন কারিগর নিজেই। তার ইচ্ছে মাটির শৈল্পিক কাজ ছড়িয়ে পড়ুক শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে।

নিজের কিছু স্যাম্পল দিয়ে কাজ শেখাবেন যতেœর সঙ্গে। নির্দিষ্ট সেশন ফি’র মাধ্যমে তিন থেকে ছয় মাসের কোর্স খুলবেন। আজকাল পড়ালেখায় ব্যবহারিক কাজের পরিমাণ বেড়েছে। তাই মৃৎ শিল্পের কাজ তাদের জীবনে এনে দেবে আলাদা মাত্রা এমনটাই জানালেন মো. বখতিয়ার রহমান খান।

×